বাংলা গল্প পাঠ-এ আজকের অণু-উপন্যাস- 'সীমান্তর সন্ন্যাস' লিখেছেন প্রতিভা বসু। এই সুন্দর রোমান্টিক বাংলা গল্পটি সানন্দা পত্রিকায় ১৯৯৩ সালের অক্টোবর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল।
সেবার এরা সবাই তাকে এয়ারপোর্টে আনতে গিয়েছিল। মা বাবা, অম্বু তার মামা-মামি, টুনটুনি, সব । অম্বুর সঙ্গে সেখানেই আলাপ। চেনে না জানে না,সে যখন প্লেন থেকে নেমে আসছে, সকলের সঙ্গে তারও কী হাত নাড়ার ঘটা। দ্বিতীয়দিন খুব সকালে কড় কড় করে ডোর বেল বেজে উঠে সীমন্তর ঘুমের দফারফা। বিরক্ত চিত্তে উঠে গিয়ে খুলতেই হল, খুলেই এক মুখ হাসি, ‘ও, আপনি ?' অম্বুকে দেখে খুশিই হয়েছিল সীমন্ত। কালকে খুব ভাল লেগেছিল মেয়েটিকে। অম্বু দেখতে ভাল। সেজন্য নয়। লাবণ্য আর সারল্য দিয়ে ভরা সারা মুখটা। তাতে এমন একটা আকর্ষণ আছে যে,এবার দেখলে আবারও দেখতে ইচ্ছে করে। অম্বু খুব ব্যস্ত। হাতে কী যেন একটা বোতলে করে নিয়ে এসেছে। সীমন্তর ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেওয়া, আর একগাল হাসির উপর এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে ‘হ্যাঁ, আমি,' বলে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ভিতরে। এ বাড়িতে আনাগোনা ওর সারাদিন। এ বাড়ির আনাচ-কানাচ সব ও চেনে। এ বাড়ির লোক দু’জন, কখন কী করে, কী খায়, কী পরে, সব ওর জানা। এ বাড়ির নিয়মকানুনের কথা সীমন্ত যা জানে না, ও তা জানে। সীমন্ত বিরক্ত হয়ে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় । শুয়ে শুয়ে শুনল অম্বু তার মাকে বলছে, বুঝলে কাকিমা, আমি কত বললাম কাকিমার ওই সাহেব ছেলে ওসব খেজুরের রসমস খাবে না,তবু মামণি শুনল না। দেবেই দেবে। মিছি মিছি আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলে, ‘দিয়ে আয় তুই, যা বলছি তা শোন।' তবু আসতে চাইনি, শেষে বলে, 'তোর মামার মোটর সাইকেলটা নিয়ে যা। মামণি কি কম চালাক ? ঠিক বুঝেছে এবার আমি উঠবই উঠব।' বলতে বলতে এক,ঝর্না হাসি। সীমন্ত কানে আঙুল দিল। এই গোলমালে কেউ ঘুমুতে পারে ? পরের দিন পথে দেখা। সীমন্ত হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল, দেখা গেল ভীষণ জোরে বাইসাইকেলে করে অম্বু সাঁ সাঁ করে কোথায় চলেছে। তাকে দেখে সাইকেলের বেগ কমিয়ে পাশাপাশি হয়ে বলল ‘কোথায় ?' সীমন্ত বলল, 'এই হাঁটছি একটু—' সে ভেবেছিল এবার মেয়েটি নিশ্চয়ই সাইকেল থেকে নামবে। নামল না। দিব্যি 'বাই বাই’ করে চলে গেল। সীমন্ত অবাক। এই অভদ্রতা সে কল্পনাও করেনি।
এরপরে সীমন্ত একদিন নিজেই গেল ওদের বাড়ি। বাবার হয়ে একটা খবর দেবারও ছিল অবশ্য। সেজন্য নয়, বিকেল বেলাটা ভালও লাগছিল না। এখানে ক্লাব-টাব আছে বটে, সেগুলো সব কোলিয়ারির চাকুরেদের জন্য। বন্ধুবান্ধব বড় একটা কেউ নেই, কী করে আর থাকবে ? দেশে তো থাকে না। সেই বছরে একবার । গিয়ে দেখল বাড়ি শুনশান। কেউ নেই। তবে বসবার ঘরের দরজাটা খোলা। পায়ে পায়ে ঢুকল, দেখল অম্বু খুব মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল, খুশি মুখে বলল, 'ওমা আপনি এসেছেন ? কী ভাল !'
সীমন্ত বলল, ‘আমি আসাটা কী অর্থে ভাল ?'
‘সে সব জানি না। ভাল লাগল তাই ভাল।'
‘বাড়ির সব কোথায় ?'
‘শহরে গেছে।'
‘ধানবাদ ?'
‘তাই হবে।'
‘আপনি যাননি কেন ?'
‘নিলে তো যাব ?'
‘কেন নিলেন না ? কী হয়েছে ?'
‘কী আবার হবে। যত সব যা তা—'
‘ব্যাপারটা কী ?'
‘ওটা পাত্রের বাড়ি, আমাকে নেওয়া যায় না।'
‘পাত্র ? পাত্র কী ?'
‘পাত্র মানেও জানেন না ?'
'না তো।'
খুব হাসল অম্বু, পাত্র মানে বর।
‘বর কার বর ?'
‘আবার কার ? আমার ।'
‘আপনার বর আছে ? কই, আমি তো জানি না। তা হলে আপনি বিবাহিত ?'
‘হেট। আমি কোন দুঃখে বিবাহিত হতে যাব ?'
‘তবে ?'
‘আরে বোকা— জিভ কাটল, ‘ঈস কী বিচ্ছিরি কথাটা বললাম—'
‘কিছু বিচ্ছিরি নয়। ব্যাপারটা কী সেটা বুঝিয়ে বলুনতো।'
‘সেটা হল, হাসতে হাসতে অস্থির, মামা আর মামণি মিলে ঠিক করেছেন— আমার বিয়ে দেবেন। ওই জন্য কার কাছে কী শুনে সেখানে গেছেন।'
‘আপনার মত আছে ?'
'আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, বললেই বিয়ে করতে চলে যাব।'
'তা হলে আপনার অমতেই তাঁরা গেছেন ?'
‘আবার কী!'
‘আপনার আপত্তি কেন ?'
‘বারে, আপনাকে যদি কেউ বিয়ে দিতে চায় অমনি আপনি বিয়ে করবেন ?'
‘আমি কেন করব ?'
'তবে আমিই বা কেন করব ?'
‘তাই তো।'
‘এবার বলুন চা না কফি।'
‘কিছু না।'
‘নিমকি খাবেন ? আমি নিজে ভেজেছি।'
মামণি বলেন, রান্নাটান্না একটু শিখে নে, সারাদিন কেবল বাইরে বাইরে ঘোরা কি ভাল ? অমনি আমি নিমকি ভেজে দেখিয়ে দিলুম, রান্নার মতো সোজা আর কিছু নেই জগতে।
সীমন্ত হাসল, 'তা হলে তো খেতেই হয়। আনুন আপনার নিমকি।'
অমনি দৌড়ে গিয়ে অম্বু এক প্লেট নিমকি নিয়ে এল । খেল সীমন্ত। সত্যি বেশ ভাল হয়েছে নিমকিগুলো। খুব প্রশংসা করল, আর প্রশংসা পেয়ে অকৃত্রিমভাবে আনন্দিত হল অম্বু।
সীমন্ত বলল, ‘সারাদিন আপনি কী করেন ?'
‘আরে, সোম থেকে শুক্রবার বিকেলে তো কামিন পাড়াতেই থাকতে হয়।'
‘কামিন পাড়াটা আবার কোথায় ?'
‘ওদের শিফটে শিফটে কাজ হয় তো ? যখন যে শিফটে যারা বাড়ি থাকে তাদের ঘরে যাই। ইংরেজ আমলে ঝুপড়ি ছিল, এখনতো আর তা নয় ? চমৎকার পাকা ব্যারাক, মাইনে প্রায় ইঞ্জিনিয়রদের সমান। হলে হবে কী, থাকতে তো জানে না। কেবল সবাই মিলে নেশা করে টাকাগুলো ফুঁকে দেয়। শুধু কি তাই ? মাসের মধ্যিখান থেকেই ধার করতে শুরু করে—'
‘আপনি কাদের কথা বলছেন ?'
‘ওই তো বললাম খনির কুলি কামিনদের কথা, যারা খনিতে নামে। কেমন করে থাকতে হয় সেটা শেখাই, মাইনে পাওয়ামাত্র প্রত্যেকের হাত থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে কখনও একটা বিছানার চাদর কিনে নিজে বিছানা পেতে দিই। কোনও মাসে কামিনদের ছাপা শাড়ি কিনে দিই, বাচ্চাদের জাঙিয়া কিনে পরিয়ে দিই-। দুদিন আবার তার মধ্যে পড়ার ক্লাস নিই। এইসব আর কি।'
‘ওরা আপনার কথা শোনে ?'
‘আগে শুনত না, ভাগিয়ে দিত। কিন্তু এখন আমাকে খুব ভালবাসে। আমিও বাসি। আমার খুব ভাল লাগে ওদের।
শুনে সীমন্ত সত্যি অবাক হল। সেতো কোনও দিন এভাবে ভাবেনি ওদের কথা । বলল, ‘আদিবাসীদের ভাষা আপনি বোঝেন ?'
‘হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা। আমি তো ওদের সঙ্গে সেই ভাষাতেই কথা বলি। আবার বাংলাও শেখাই।'
‘কিছু কি শিখল ?'
‘ঠিক শিখেছে বলতে না পারলেও, বলা যায় শিখছে। আমি বলি যাদের তোমরা বাবু বল, তোমরা কিন্তু তাদেরই মতো মাইনে পাও। আবার এদিকে বাড়িটা ফ্রি, বেশ সুন্দর একটা ঘর সকলের, কিন্তু হলে হবে কী, ঝুপড়ি থেকে যে পাকা ঘরে এসেছে সেই বোধও তাদের নেই। তাছাড়া যেখানে সেখানে বাথরুম করে। আমি আস্তে আস্তে ওদের সব শেখাব । জীবনযাপনের তারতম্যেই যে মানুষ সভ্য হয় এটা ওদের জানানো দরকার । বেশি। টাকা দিলেই তো হল না, টাকাটা কীভাবে খরচ করলে মানুষ মনুষ্য পদবাচ্য হয়, সেটা তো আগে শেখাতে হবে ?'
অম্বুর কথা শুনে সীমন্ত অবাক হল। মনে মনে শ্রদ্ধা করল মেয়েটিকে। হয়তো বা কিছুটা আকর্ষণও বোধ করল। তা নইলে সেবার প্রবাসে ফিরে গিয়ে মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে করে অত উন্মনা হত না। ভাল বাংলা লিখতে পারে না। তবু চেষ্টা চরিত্র করে বাংলায় একটা চিঠিও লিখে ফেলেছিল, যেটা আর শেষে ডাকে দেওয়া হয়নি। যাবার আগের দিন পথে মুখোমুখি দেখা, হেসে বলল, ‘এমা, আপনি বেরিয়ে পড়েছেন ?'
‘কেন ?'
‘আমি যে আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।'
‘তবে চলুন ফিরে যাই।' সীমন্তও যে তাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল সে কথাটা আর বলল না।
অম্বু বলল, 'না, থাক। কোথায় যাচ্ছিলেন, হয়তো কোনও কাজে-'
'না না, এখানে আর আমার কী কাজ ! চলুন। আমিতো কালই চলে যাচ্ছি।'
‘সেই তো। মামুতো তাই বললেন। ওঁরা বলছিলেন আপনার মা-বাবার কত খারাপ লাগবে।'
একটু অভিযোগের সুরে সীমন্ত বলল, 'ওঁদের তো খারাপ লাগা উচিত নয়। ওঁরাই তো সাহেব বানাতে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে রেখেছেন। আমার কথা আপনার মনে থাকবে ?'
‘কেন থাকবে না, আমি কি বুদ্ধ না আমার স্মরণশক্তি বলে কিছু নেই !'
‘স্মরণশক্তির ছাঁকনিতে বাজে জিনিস সর্বদাই ফেলা যায় কি না।'
‘আপনি কিন্তু খুব ভাল বাংলা বলেন। এজন্য আপনাকে ক্রেডিট দিতেই হয়।'
‘বাংলাইতো আমার ভাষা। আমি সব সময় চেষ্টা করি ভুলে না যাই। ওখানে আমার তিনটে বাঙালি পরিবারের সঙ্গে যোগ আছে। তাদের সঙ্গে সব সময় বাংলা বলি, কিন্তু এখন মুশকিল ওরা আবার ইংরিজি বলে। বিশেষত ওদের মেয়ে।' ‘ওদের মেয়ে আছে বুঝি ?'
‘আপনার বয়সী।' একথা বলে সীমন্ত বোধহয় অম্বুর মনে একটু ঈর্ষা জাগাতে চেয়েছিল ।
অম্বু সে রাস্তায় পা দেবার মেয়েই নয়। বেজার মুখে বলল, 'আমার না এখানে একটাও মেয়ে বন্ধু নেই ! ওঁরা যদি এখানে থাকতেন কী ভাল হত।'
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দরজায় চলে এল ।
সীমন্ত তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
অম্বু বলল, ‘আপনি যেদিন এলেন, এ ঘরটা কিন্তু আমি গুছিয়ে দিয়েছিলাম। আপনার পছন্দ হয়েছিল ?'
‘তাই নাকি ? আপনি গুছিয়ে দিয়েছিলেন ?'
‘কাকিমা বলল, সমুর ঘরটা তুই গুছিয়ে দে। আমি তখন কী যত্ন করে গুছোলাম না—'
‘তাই এত সুন্দর লাগছিল ঘরটা।'
‘বাজে কথা। এতদিন কিছু না বলে যাবার আগের দিন বলা হচ্ছে সুন্দর লেগেছে। এদিকে আমি রোজ আশা করি কখন বলেন যে ঘরটা খুব সুন্দর গোছান ছিল।'
‘পাগল। আমি কি জানতাম নাকি কে গুছিয়েছে ? জানলে তো আমারই ভাল লাগত বেশি।' ‘কেন ?'
‘কেন আবার কী! আপনি গুছিয়েছেন তাই।'
‘আমি জানি সাহেবরা খুব মনরাখা কথা বলতে পারে।'
‘আমি কি সাহেব ?'
'ওরে বাবা। পাক্কা সাহেব। সাহেবদের চেহারাই আলাদা।'
‘সাহেবরা বুঝি খুব সুন্দর হয় ?'
‘দারুণ। কী ভাল লাগে দেখতে।'
‘আর আমাকে ?'
‘আপনাকে ? আপনি তো তাদের চেয়েও সুন্দর।'
‘ধন্যবাদ। এর চেয়ে সুখের কথা আর কী আছে আমার কাছে।'
‘আহা একথা যেন আমিই প্রথম বললাম।'
বলেই উঠে দাঁড়াল, ‘যাই দেখিগে, কাকু-কাকিমা কী করছেন।'
সীমান্ত বলল, 'প্লিজ আর একটু বসুন। কাকু কাকিমা তো আছেনই। আমি তো কাল ভোর না হতেই চলে যাব।'
‘আচ্ছা না গেলে কী হয় ?'
‘এতদিন যার জন্য রইলাম সেটা তো সমাপ্ত করতে হবে ?'
‘তাই তো। কিন্তু আবার আসতে তো সেই একবছর। বাবা, কত দেরি। হয়তো আর দেখাই হবে না।'
‘কেন ? কেন হবে না।' সীমন্ত একটা অস্থির জিজ্ঞাসা নিয়ে অম্বুর দিকে তাকাল।
অম্বু হাসল, কিছু বলল না।
সীমন্ত বলল, 'সেদিন তারপর কী হল ?'
‘কবে ? কোনদিন ?' 'ওই যে সবাই আপনার জন্য বর দেখতে গিয়েছিলেন ?'
‘মামণিতো আমার কানের কাছে রোজই তাদের প্রশংসা করে করে বধির করে দিলেন।'
'আর আপনি ?'
'আমি আবার কী ? মামণি বলেন আমি শুনি।'
‘নিজে কিছু স্থির করেননি ?'
‘তাতে একটু করেইছি। মামা-মামণি আমাকে যত বাচ্চা বা অপরিণত ভাবেন আমি তো সত্যিই তা নই ?'
'নিশ্চয়ই না।'
'তবে যদি কখনও আমার নিজের কাউকে ভাল লাগে, তখন না হয় দেখা যাবে।'
‘ঠিক বলেছেন। কিন্তু কারওকে কি আপনার আজ পর্যন্ত ভাল লাগেনি ?'
সীমন্তর মা ঘরে এলেন, ‘অম্বু, তোর মামণি তোকে ডেকে পাঠিয়েছে, জরুরি তলব। চলে যা তাড়াতাড়ি । অম্বু তৎক্ষণাৎ চলে গেল,
জবাবটা আর শোনা গেল না।
পরের দিন ভোর ছটায় প্লেন। যেমন আনতে গিয়েছিল তেমনই আবার ভোররাতে বিদায় দিতেও দু’বাড়ির লোক এয়ারপোর্টে গেল।
যাবার মুহূর্তে সীমন্ত একটু নিভৃতে অম্বুর হাতে আস্তে একটু চাপ দিয়ে বলল, 'আশা করি ভুলে। যাবেন না।'
অম্বু মুখ তুলল না, অস্ফুটে বলল, ‘আমিও কি সেটা আশা করতে পারি ?'
সীমন্ত দৃঢ়স্বরে বলল, 'নিশ্চয়ই।'
ঘন ঘন ঘোষণা শুনে এবার দৌড়তে হল সীমন্তকে। আর পরের বছর এসে দেখা গেল দুজনেই দুজনের কথা রেখেছে। কেউ কাউকে ভুলে যায়নি। এবং ভুলে না যাওয়াটা অনেকটা গভীরেই পৌঁছে গেল । যদিও অম্বু তখনও সুদূর। সীমন্তর অনেকদিনই মনে হয় অম্বুর বিষয়ে তার মন যেভাবে কাজ করে, অম্বুর মন সেদিকে নেই। অসহ্য রাগে তৎক্ষণাৎ ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। না চাইতে পাওয়া গেলে আপ্রাণ চেয়েও পাচ্ছে না এ অপমান সহ্য করতে পারে না।
সীমন্ত না জানলেও অম্বু জানত, এই রাজপুত্রকে সে কোনও দিনই পাবে না । সীমন্তর মা বাবার কল্পনায় সে কোথাও নেই। তাঁদের চিত্র তাঁরা এঁকেই রেখেছেন। মেয়ে গিরিডিতে আছে। যার বাবাকে সবাই মাইকাপ্রিন্স বলে। সীমন্ত একদিন বলল, ‘অম্বু তুমি চম্পানদী দেখেছ ?'
‘চম্পানদী ? কোথায় ? কতদূরে ? আমি তো জানি না।'
'যাবে ?'
সীমন্ত যে কবে থেকে অষুকে তুমি বলে, অম্বুও জানে না সীমন্তও জানে না। মনে মনে তুমিই ছিল, তাই বোধহয় আর আপনিটা
আসেনি মুখে । চুপ করে থেকে অম্বু বলল, ‘সবাই যাবে ?'
‘না, কেবল তুমি আর আমি।'
‘আপনি আর আমি ?'
‘তুমি আমাকে আপনি বলাটা ছাড়তে পার না?'
‘তাতে কী বা এসে যায়। আপনিই বলি, তুমিই বলি সবই সমান।'
'না সমান নয়। তুমিটা অনেক কাছের।'
অম্বু হাসল, ‘এক মাসের তো মেয়াদ। চোখের পলকে কখন কেটে যাবে। এর মধ্যেই তো দু সপ্তাহ কেটে গেল। তারপর আবার একবছর। কে কোথায় ভেসে যাব কে জানে।'
‘বাজে কথা বলতে তুমি খুব ভালবাস।'
‘কাকু কাকিমা তো বলছিলেন পরের বছর আর আপনি-'
‘উহুঁ, আর আপনি নয়, বল তুমি-'
'কথাটা শেষ করি ?'
'করো। কিন্তু আর আপনি বলবে না।'
কাকু-কাকিমা কী বলছিলেন ?
‘বলছিলেন আগামী বছর ওঁরাই যাবেন।'
‘আমার কাজ আর এক বছরেরই বাকি আছে। ওঁরা যান যাবেন, তাতে আমার আসা আটকাবে না। কাজ শেষ হলে আর একদিনও আমি থাকব না। অম্বু তুমি কি কিছু বোঝো না ? কাল চল চম্পানদীর ধারে যাই, এবার তোমার কাছ থেকে আমি একটা কথা নিয়ে যাবই ।'
‘সেটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না ?'
‘হোক। আমি গ্রাহ্য করি না।'
‘আমি করি।'
‘আমার সঙ্গে একা বেরোবার সাহস নেই তোমার ?'
‘মেয়েদের সাহসের পরিধি বড় কম। মা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই, বোন নেই, মামা-মামির কাছে প্রতিপালিত একটা মেয়ে আমি। আমার মামামামি যদিও আমার মা বাবার চাইতে আমার কাছে একবিন্দু কম নন, তাঁরা আমাকে সন্তানের অধিক ভালবাসেন তথাপি আমার অবস্থা বড় করুণ। সকলেই করুণা দেখায়। না, করুণার পাত্র আমি হব না। মরে গেলেও না।
‘এসব বাজে কথা বলছ কেন ? তুমিতো তুমিই, তোমার অস্তিত্বটাই আমার কাছে আসল। আমি তাছাড়া আর কিছু চাই না।'
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অম্বু বলল, 'চল, বাড়ি যাই। খুব সহজেই তার মুখ থেকে এই ‘তুমি’টা বেরিয়ে এল। আর হঠাৎ সীমন্ত যা কখনও করেনি সন্ধ্যার অন্ধকার নির্জনে অম্বুকে দুই হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে গভীর আবেগে চুম্বন করল। অম্বু জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। সীমন্ত বলল, ‘গণ্ডি এঁকে দিয়ে গেলাম, যাতে আর কেউ এ গণ্ডি না পেরোতে পারে।'
* বিগত পোষ্টে যে অনু উপন্যাসটি দেওয়া হয়েছিল, সেটা হল- 'পাতী অরণ্যের এক উপদেবতা- বাণী বসু' আপনারা চাইলে এখানে ক্লিক করে গল্পটি পড়তে পারেন।
সীমান্তর সন্ন্যাস
প্রতিভা বসু
'এই যে ঠাকুরমশাই,আপনার ফুল নিন।'
ঠক করে ফুলের সাজিটা মেঝেতে বসিয়ে দিয়ে অম্বু একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে তেরচা চোখে তাকিয়ে বলল, 'দেখা হয়েছে। তেনার সঙ্গে ?' উপরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। যাকে বলা হল সে নিস্তব্ধ। নিজের কুটিরের মাটির দাওয়ায় একটি বকুল গাছের তলায় পূর্বদিকে মুখ করে যুক্তাসনে বসে আছে সে। সারা আকাশে আবির ছড়িয়ে ধীরে ধীরে সূর্য উঠে আসছে নীচে থেকে। দৃশ্যটি দেখারই যোগ্য। সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে যুক্তাসনে উপবিষ্ট ঠাকুরমশাইটি গম্ভীর স্বরে ডাকল, অম্বু—
অম্বু তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, 'হুজুরে হাজির।'
‘তুমি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ ?'
‘ছিছি তাও কি কখনও হয় ?'
‘আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়—'
‘অনেক বিদ্বান অনেক বুদ্ধিমান তার উপরে ঈশ্বরের সঙ্গে ডিরেক্ট কানেকশন চলছে—'
‘আমি চাই না যখন তখন এসে আমাকে কেউ বিরক্ত করুক।'
‘সে তো ঠিক।'
'তবে ? তবে তুমি কী চাও ?'
‘কিছু না। আজকাল আমাদের বাগানে খুব ফুল ফোটে। ভাবলাম ঠাকুরমশাইকে দিয়ে আসি, সুগন্ধ ফুল দিয়ে পুজো করলে নিশ্চয়ই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ঈশ্বরমশাই তাড়াতাড়ি নেমে আসবেন।' ‘কী আস্পর্ধা' ঈশ্বরভক্ত যুবকটি। স্বগতোক্তিতে বলল, 'কী আস্পর্ধা'। প্রকাশ্যে বলল, ‘আমি অনেক দিন তোমাকে এখানে আসতে বারণ করেছি—'
‘আমি শুনিনি, এইতো ?'
‘তবে তো বুঝতেই পেরেছ।'
‘আজকাল তোমাকে তো তোমার ঘরে পাওয়াই যায় না, তাই ভাবলাম চলে যাবার আগে ওখানে গিয়েই একবার দেখা করে যাই।'
‘চলে যাবার আগে মানে ? সাধু যুবকের ভুরু কুঁচকাল। অম্বু বলল, 'বারে, আমার মামা বদলি হয়ে যাচ্ছে না এখান থেকে ?'
‘কই, আমি তো শুনিনি।'
‘না শুনেছ, এখন তো শুনলে, সুতরাং ক্ষমা করে দিও। অম্বু চলে যাচ্ছিল, সাধু যুবক যুক্তাসনের ধ্যান থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। 'শোনো'।
‘বল—'
‘কখন যাচ্ছ ?'
‘যত তাড়াতাড়ি হয়, মামা তত তাড়াতাড়িই যাবেন। মানে উনি রোদ চড়ার আগেই বেরিয়ে পড়তে চান।'
‘গাড়িতে যাচ্ছ ?'
‘তাইতো জানি।'
‘মামা কোথায় বদলি হলেন '?
‘আসানসোল। তবে আপাতত কয়েকদিন কলকাতা থাকবেন।'
‘আর তুমি ?'
‘আমি আবার কী ?'
'না, মানে, তুমি কী করবে ?'
‘শুনছি আমাকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করে দেবেন।'
'তবেতো ভালই হল।'
‘হয়তো।'
‘তা বলে আজই যাচ্ছ ?'
উত্তর দেওয়া নিরর্থক। মৃদু হেসে চলে গেল অম্বু।
সাধু যুবকটির সাধনায় ব্যাঘাত ঘটল। দূরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল । অম্বুর নাম অম্বালিকা মৈত্র। এখানকার ইস্কুল থেকে বারো ক্লাস পাশ করে বসে আছে। এখানে কলেজ নেই। এখন ঠিক হয়েছে মামা তাকে শান্তিনিকেতনেই পাঠাবেন। ওখানেই হস্টেলে থেকে পড়বে। রেজাল্টে নম্বরের জোর আছে, ভর্তি হতে যে আটকাবে না সে খবরও পেয়েছেন। অম্বুর মা বাবা ভাইবোন কেউ নেই। মামা-মামিই তার সব। তাঁদের কাছে তাঁদের মেয়ে টুনটুনির চেয়েও তার আদর বেশি। অবশ্য টুনটুনি তার দিদির ল্যাজ। সারাক্ষণ পিছনে পিছনে ঘুরছে। দিদিও টুনটুনিকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। এই টুনটুনিই মামার একমাত্র মেয়ে। ছেলেও আছে একটি, টুনটুনির চাইতে পনেরো বছরের বড়। মামা-মামি কল্পনাও করেননি— এতকাল বাদে আবার একটা মেয়ে হতে পারে। এখন টুনটুনির বয়েস সাত আর তার দাদার বয়েস বাইশ ! প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, এম. এ. দিচ্ছে। অম্বালিকারই একটা বছর নষ্ট হল এখানে বসে থেকে। মামা কোলিয়ারিতে কাজ করেন, তার মানেই বদলির চাকরি। আর সীমন্তর বাবা বলতে গেলে এখানকার রাজা। পিতার আমল থেকে একটি কোলিয়ারির মালিক। গিরিডিতেও মাইকার ব্যবসা আছে। এখানে বাগান, পুকুর নিয়ে মস্ত বাড়ি, এ বাড়িতেই থাকেন। গিরিডি মাত্রই কয়েক মাইলের রাস্তা, প্রয়োজনমতো গাড়িতেই যাতায়াত করেন। একমাত্র সন্তান সীমন্তকে অল্পবয়েস থেকেই বিদেশে রেখে পড়াচ্ছেন। তবে প্রত্যেক বছরই শীতের সময় আসে, একমাস থেকে চলে যায়। মধ্যে আর একবার বাবা গিয়ে কয়েকদিন থেকে দেখে আসেন তাকে। অম্বুরা যখন এখানে এল, তখন সীমন্ত সদ্য যুবক। ছোট থেকেই শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে মিলে মিশে থেকে হালচাল তার প্রায় ওদেরই মতো। ধনীর পুত্র, যা যখন চেয়েছে, তাই তখনই পেয়েছে। সবই অনায়াসলভ্য। তারুণ্যের গণ্ডি পেরোতে পেরোতে, দেখা গেল প্রেমও অনায়াসলভ্য,অন্তত সেই দেশে। প্রকৃতপক্ষে অনায়াসলভ্যের প্রতি তার একটা অনীহারই জন্ম হল । একবার ছুটিতে এসে বাবার এই বন্ধু পরিবারটির সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হল, তখন এই অম্বু নামের মেয়েটিকে দেখে বেশ একটু অন্যরকম মনে হল। অম্বু ওকে একেবারে গ্রাহ্যই করল না। মামার মোটর সাইকেলটার উপরই তার যত মনোযোগ, কোলিয়ারিতে ঘুরে ঘুরে সব সময়েই প্রায় প্রান্তিক শহরের বিরাট বিরাট মাঠেঘাটে ওই মোটর সাইকেলটি পেলেই বোনটিকে পিছনে নিয়ে ভটভটিয়ে দূর-দূরান্তে কোথায় কোথায় চলে যায়। কী স্বদেশে কী বিদেশে কোনও তরুণী যে আলাপ হবার পরে, যথার্থ পরিচয়ের পরেও তাকে অগ্রাহ্য করে এবং তার চাইতে অন্য কিছুর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হতে পারে- এ যেন সীমন্তর দেখেও বিশ্বাস হয় না। প্রথমবার এসে বাবার এই বন্ধু পরিবারটির সঙ্গে আলাপ হবার পরে সে আরও দেখল একটি ঘেয়ো কুকুরছানা নিয়েও অম্বু খুব ব্যস্ত, অ্যাসিটেন্ট তার পুঁচকে ভগ্নী টুনটুনি। দিদির হুকুমে সে উঠছে, বসছে। মাঝে মাঝেই দিদিটি নিচু গলায় বলছে, 'দেখে আয়তো মামা কোথায়। মোটর সাইকেলটা নিয়ে খনিতে গিয়েছেন,না কি ওটা বাড়িতেই আছে।' এ বিষয়ে ভগ্নীর উৎসাহ দিদির চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। সেতো জানে দিদি গেলে সেও পিছনে বসে হাওয়া খাবে।
ঠক করে ফুলের সাজিটা মেঝেতে বসিয়ে দিয়ে অম্বু একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে তেরচা চোখে তাকিয়ে বলল, 'দেখা হয়েছে। তেনার সঙ্গে ?' উপরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। যাকে বলা হল সে নিস্তব্ধ। নিজের কুটিরের মাটির দাওয়ায় একটি বকুল গাছের তলায় পূর্বদিকে মুখ করে যুক্তাসনে বসে আছে সে। সারা আকাশে আবির ছড়িয়ে ধীরে ধীরে সূর্য উঠে আসছে নীচে থেকে। দৃশ্যটি দেখারই যোগ্য। সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে যুক্তাসনে উপবিষ্ট ঠাকুরমশাইটি গম্ভীর স্বরে ডাকল, অম্বু—
অম্বু তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, 'হুজুরে হাজির।'
‘তুমি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ ?'
‘ছিছি তাও কি কখনও হয় ?'
‘আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়—'
‘অনেক বিদ্বান অনেক বুদ্ধিমান তার উপরে ঈশ্বরের সঙ্গে ডিরেক্ট কানেকশন চলছে—'
‘আমি চাই না যখন তখন এসে আমাকে কেউ বিরক্ত করুক।'
‘সে তো ঠিক।'
'তবে ? তবে তুমি কী চাও ?'
‘কিছু না। আজকাল আমাদের বাগানে খুব ফুল ফোটে। ভাবলাম ঠাকুরমশাইকে দিয়ে আসি, সুগন্ধ ফুল দিয়ে পুজো করলে নিশ্চয়ই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ঈশ্বরমশাই তাড়াতাড়ি নেমে আসবেন।' ‘কী আস্পর্ধা' ঈশ্বরভক্ত যুবকটি। স্বগতোক্তিতে বলল, 'কী আস্পর্ধা'। প্রকাশ্যে বলল, ‘আমি অনেক দিন তোমাকে এখানে আসতে বারণ করেছি—'
‘আমি শুনিনি, এইতো ?'
‘তবে তো বুঝতেই পেরেছ।'
‘আজকাল তোমাকে তো তোমার ঘরে পাওয়াই যায় না, তাই ভাবলাম চলে যাবার আগে ওখানে গিয়েই একবার দেখা করে যাই।'
‘চলে যাবার আগে মানে ? সাধু যুবকের ভুরু কুঁচকাল। অম্বু বলল, 'বারে, আমার মামা বদলি হয়ে যাচ্ছে না এখান থেকে ?'
‘কই, আমি তো শুনিনি।'
‘না শুনেছ, এখন তো শুনলে, সুতরাং ক্ষমা করে দিও। অম্বু চলে যাচ্ছিল, সাধু যুবক যুক্তাসনের ধ্যান থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। 'শোনো'।
‘বল—'
‘কখন যাচ্ছ ?'
‘যত তাড়াতাড়ি হয়, মামা তত তাড়াতাড়িই যাবেন। মানে উনি রোদ চড়ার আগেই বেরিয়ে পড়তে চান।'
‘গাড়িতে যাচ্ছ ?'
‘তাইতো জানি।'
‘মামা কোথায় বদলি হলেন '?
‘আসানসোল। তবে আপাতত কয়েকদিন কলকাতা থাকবেন।'
‘আর তুমি ?'
‘আমি আবার কী ?'
'না, মানে, তুমি কী করবে ?'
‘শুনছি আমাকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করে দেবেন।'
'তবেতো ভালই হল।'
‘হয়তো।'
‘তা বলে আজই যাচ্ছ ?'
উত্তর দেওয়া নিরর্থক। মৃদু হেসে চলে গেল অম্বু।
সাধু যুবকটির সাধনায় ব্যাঘাত ঘটল। দূরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল । অম্বুর নাম অম্বালিকা মৈত্র। এখানকার ইস্কুল থেকে বারো ক্লাস পাশ করে বসে আছে। এখানে কলেজ নেই। এখন ঠিক হয়েছে মামা তাকে শান্তিনিকেতনেই পাঠাবেন। ওখানেই হস্টেলে থেকে পড়বে। রেজাল্টে নম্বরের জোর আছে, ভর্তি হতে যে আটকাবে না সে খবরও পেয়েছেন। অম্বুর মা বাবা ভাইবোন কেউ নেই। মামা-মামিই তার সব। তাঁদের কাছে তাঁদের মেয়ে টুনটুনির চেয়েও তার আদর বেশি। অবশ্য টুনটুনি তার দিদির ল্যাজ। সারাক্ষণ পিছনে পিছনে ঘুরছে। দিদিও টুনটুনিকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। এই টুনটুনিই মামার একমাত্র মেয়ে। ছেলেও আছে একটি, টুনটুনির চাইতে পনেরো বছরের বড়। মামা-মামি কল্পনাও করেননি— এতকাল বাদে আবার একটা মেয়ে হতে পারে। এখন টুনটুনির বয়েস সাত আর তার দাদার বয়েস বাইশ ! প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, এম. এ. দিচ্ছে। অম্বালিকারই একটা বছর নষ্ট হল এখানে বসে থেকে। মামা কোলিয়ারিতে কাজ করেন, তার মানেই বদলির চাকরি। আর সীমন্তর বাবা বলতে গেলে এখানকার রাজা। পিতার আমল থেকে একটি কোলিয়ারির মালিক। গিরিডিতেও মাইকার ব্যবসা আছে। এখানে বাগান, পুকুর নিয়ে মস্ত বাড়ি, এ বাড়িতেই থাকেন। গিরিডি মাত্রই কয়েক মাইলের রাস্তা, প্রয়োজনমতো গাড়িতেই যাতায়াত করেন। একমাত্র সন্তান সীমন্তকে অল্পবয়েস থেকেই বিদেশে রেখে পড়াচ্ছেন। তবে প্রত্যেক বছরই শীতের সময় আসে, একমাস থেকে চলে যায়। মধ্যে আর একবার বাবা গিয়ে কয়েকদিন থেকে দেখে আসেন তাকে। অম্বুরা যখন এখানে এল, তখন সীমন্ত সদ্য যুবক। ছোট থেকেই শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে মিলে মিশে থেকে হালচাল তার প্রায় ওদেরই মতো। ধনীর পুত্র, যা যখন চেয়েছে, তাই তখনই পেয়েছে। সবই অনায়াসলভ্য। তারুণ্যের গণ্ডি পেরোতে পেরোতে, দেখা গেল প্রেমও অনায়াসলভ্য,অন্তত সেই দেশে। প্রকৃতপক্ষে অনায়াসলভ্যের প্রতি তার একটা অনীহারই জন্ম হল । একবার ছুটিতে এসে বাবার এই বন্ধু পরিবারটির সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হল, তখন এই অম্বু নামের মেয়েটিকে দেখে বেশ একটু অন্যরকম মনে হল। অম্বু ওকে একেবারে গ্রাহ্যই করল না। মামার মোটর সাইকেলটার উপরই তার যত মনোযোগ, কোলিয়ারিতে ঘুরে ঘুরে সব সময়েই প্রায় প্রান্তিক শহরের বিরাট বিরাট মাঠেঘাটে ওই মোটর সাইকেলটি পেলেই বোনটিকে পিছনে নিয়ে ভটভটিয়ে দূর-দূরান্তে কোথায় কোথায় চলে যায়। কী স্বদেশে কী বিদেশে কোনও তরুণী যে আলাপ হবার পরে, যথার্থ পরিচয়ের পরেও তাকে অগ্রাহ্য করে এবং তার চাইতে অন্য কিছুর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হতে পারে- এ যেন সীমন্তর দেখেও বিশ্বাস হয় না। প্রথমবার এসে বাবার এই বন্ধু পরিবারটির সঙ্গে আলাপ হবার পরে সে আরও দেখল একটি ঘেয়ো কুকুরছানা নিয়েও অম্বু খুব ব্যস্ত, অ্যাসিটেন্ট তার পুঁচকে ভগ্নী টুনটুনি। দিদির হুকুমে সে উঠছে, বসছে। মাঝে মাঝেই দিদিটি নিচু গলায় বলছে, 'দেখে আয়তো মামা কোথায়। মোটর সাইকেলটা নিয়ে খনিতে গিয়েছেন,না কি ওটা বাড়িতেই আছে।' এ বিষয়ে ভগ্নীর উৎসাহ দিদির চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। সেতো জানে দিদি গেলে সেও পিছনে বসে হাওয়া খাবে।
সেবার এরা সবাই তাকে এয়ারপোর্টে আনতে গিয়েছিল। মা বাবা, অম্বু তার মামা-মামি, টুনটুনি, সব । অম্বুর সঙ্গে সেখানেই আলাপ। চেনে না জানে না,সে যখন প্লেন থেকে নেমে আসছে, সকলের সঙ্গে তারও কী হাত নাড়ার ঘটা। দ্বিতীয়দিন খুব সকালে কড় কড় করে ডোর বেল বেজে উঠে সীমন্তর ঘুমের দফারফা। বিরক্ত চিত্তে উঠে গিয়ে খুলতেই হল, খুলেই এক মুখ হাসি, ‘ও, আপনি ?' অম্বুকে দেখে খুশিই হয়েছিল সীমন্ত। কালকে খুব ভাল লেগেছিল মেয়েটিকে। অম্বু দেখতে ভাল। সেজন্য নয়। লাবণ্য আর সারল্য দিয়ে ভরা সারা মুখটা। তাতে এমন একটা আকর্ষণ আছে যে,এবার দেখলে আবারও দেখতে ইচ্ছে করে। অম্বু খুব ব্যস্ত। হাতে কী যেন একটা বোতলে করে নিয়ে এসেছে। সীমন্তর ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেওয়া, আর একগাল হাসির উপর এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে ‘হ্যাঁ, আমি,' বলে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ভিতরে। এ বাড়িতে আনাগোনা ওর সারাদিন। এ বাড়ির আনাচ-কানাচ সব ও চেনে। এ বাড়ির লোক দু’জন, কখন কী করে, কী খায়, কী পরে, সব ওর জানা। এ বাড়ির নিয়মকানুনের কথা সীমন্ত যা জানে না, ও তা জানে। সীমন্ত বিরক্ত হয়ে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় । শুয়ে শুয়ে শুনল অম্বু তার মাকে বলছে, বুঝলে কাকিমা, আমি কত বললাম কাকিমার ওই সাহেব ছেলে ওসব খেজুরের রসমস খাবে না,তবু মামণি শুনল না। দেবেই দেবে। মিছি মিছি আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলে, ‘দিয়ে আয় তুই, যা বলছি তা শোন।' তবু আসতে চাইনি, শেষে বলে, 'তোর মামার মোটর সাইকেলটা নিয়ে যা। মামণি কি কম চালাক ? ঠিক বুঝেছে এবার আমি উঠবই উঠব।' বলতে বলতে এক,ঝর্না হাসি। সীমন্ত কানে আঙুল দিল। এই গোলমালে কেউ ঘুমুতে পারে ? পরের দিন পথে দেখা। সীমন্ত হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল, দেখা গেল ভীষণ জোরে বাইসাইকেলে করে অম্বু সাঁ সাঁ করে কোথায় চলেছে। তাকে দেখে সাইকেলের বেগ কমিয়ে পাশাপাশি হয়ে বলল ‘কোথায় ?' সীমন্ত বলল, 'এই হাঁটছি একটু—' সে ভেবেছিল এবার মেয়েটি নিশ্চয়ই সাইকেল থেকে নামবে। নামল না। দিব্যি 'বাই বাই’ করে চলে গেল। সীমন্ত অবাক। এই অভদ্রতা সে কল্পনাও করেনি।
এরপরে সীমন্ত একদিন নিজেই গেল ওদের বাড়ি। বাবার হয়ে একটা খবর দেবারও ছিল অবশ্য। সেজন্য নয়, বিকেল বেলাটা ভালও লাগছিল না। এখানে ক্লাব-টাব আছে বটে, সেগুলো সব কোলিয়ারির চাকুরেদের জন্য। বন্ধুবান্ধব বড় একটা কেউ নেই, কী করে আর থাকবে ? দেশে তো থাকে না। সেই বছরে একবার । গিয়ে দেখল বাড়ি শুনশান। কেউ নেই। তবে বসবার ঘরের দরজাটা খোলা। পায়ে পায়ে ঢুকল, দেখল অম্বু খুব মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল, খুশি মুখে বলল, 'ওমা আপনি এসেছেন ? কী ভাল !'
সীমন্ত বলল, ‘আমি আসাটা কী অর্থে ভাল ?'
‘সে সব জানি না। ভাল লাগল তাই ভাল।'
‘বাড়ির সব কোথায় ?'
‘শহরে গেছে।'
‘ধানবাদ ?'
‘তাই হবে।'
‘আপনি যাননি কেন ?'
‘নিলে তো যাব ?'
‘কেন নিলেন না ? কী হয়েছে ?'
‘কী আবার হবে। যত সব যা তা—'
‘ব্যাপারটা কী ?'
‘ওটা পাত্রের বাড়ি, আমাকে নেওয়া যায় না।'
‘পাত্র ? পাত্র কী ?'
‘পাত্র মানেও জানেন না ?'
'না তো।'
খুব হাসল অম্বু, পাত্র মানে বর।
‘বর কার বর ?'
‘আবার কার ? আমার ।'
‘আপনার বর আছে ? কই, আমি তো জানি না। তা হলে আপনি বিবাহিত ?'
‘হেট। আমি কোন দুঃখে বিবাহিত হতে যাব ?'
‘তবে ?'
‘আরে বোকা— জিভ কাটল, ‘ঈস কী বিচ্ছিরি কথাটা বললাম—'
‘কিছু বিচ্ছিরি নয়। ব্যাপারটা কী সেটা বুঝিয়ে বলুনতো।'
‘সেটা হল, হাসতে হাসতে অস্থির, মামা আর মামণি মিলে ঠিক করেছেন— আমার বিয়ে দেবেন। ওই জন্য কার কাছে কী শুনে সেখানে গেছেন।'
‘আপনার মত আছে ?'
'আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, বললেই বিয়ে করতে চলে যাব।'
'তা হলে আপনার অমতেই তাঁরা গেছেন ?'
‘আবার কী!'
‘আপনার আপত্তি কেন ?'
‘বারে, আপনাকে যদি কেউ বিয়ে দিতে চায় অমনি আপনি বিয়ে করবেন ?'
‘আমি কেন করব ?'
'তবে আমিই বা কেন করব ?'
‘তাই তো।'
‘এবার বলুন চা না কফি।'
‘কিছু না।'
‘নিমকি খাবেন ? আমি নিজে ভেজেছি।'
মামণি বলেন, রান্নাটান্না একটু শিখে নে, সারাদিন কেবল বাইরে বাইরে ঘোরা কি ভাল ? অমনি আমি নিমকি ভেজে দেখিয়ে দিলুম, রান্নার মতো সোজা আর কিছু নেই জগতে।
সীমন্ত হাসল, 'তা হলে তো খেতেই হয়। আনুন আপনার নিমকি।'
অমনি দৌড়ে গিয়ে অম্বু এক প্লেট নিমকি নিয়ে এল । খেল সীমন্ত। সত্যি বেশ ভাল হয়েছে নিমকিগুলো। খুব প্রশংসা করল, আর প্রশংসা পেয়ে অকৃত্রিমভাবে আনন্দিত হল অম্বু।
সীমন্ত বলল, ‘সারাদিন আপনি কী করেন ?'
‘আরে, সোম থেকে শুক্রবার বিকেলে তো কামিন পাড়াতেই থাকতে হয়।'
‘কামিন পাড়াটা আবার কোথায় ?'
‘ওদের শিফটে শিফটে কাজ হয় তো ? যখন যে শিফটে যারা বাড়ি থাকে তাদের ঘরে যাই। ইংরেজ আমলে ঝুপড়ি ছিল, এখনতো আর তা নয় ? চমৎকার পাকা ব্যারাক, মাইনে প্রায় ইঞ্জিনিয়রদের সমান। হলে হবে কী, থাকতে তো জানে না। কেবল সবাই মিলে নেশা করে টাকাগুলো ফুঁকে দেয়। শুধু কি তাই ? মাসের মধ্যিখান থেকেই ধার করতে শুরু করে—'
‘আপনি কাদের কথা বলছেন ?'
‘ওই তো বললাম খনির কুলি কামিনদের কথা, যারা খনিতে নামে। কেমন করে থাকতে হয় সেটা শেখাই, মাইনে পাওয়ামাত্র প্রত্যেকের হাত থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে কখনও একটা বিছানার চাদর কিনে নিজে বিছানা পেতে দিই। কোনও মাসে কামিনদের ছাপা শাড়ি কিনে দিই, বাচ্চাদের জাঙিয়া কিনে পরিয়ে দিই-। দুদিন আবার তার মধ্যে পড়ার ক্লাস নিই। এইসব আর কি।'
‘ওরা আপনার কথা শোনে ?'
‘আগে শুনত না, ভাগিয়ে দিত। কিন্তু এখন আমাকে খুব ভালবাসে। আমিও বাসি। আমার খুব ভাল লাগে ওদের।
শুনে সীমন্ত সত্যি অবাক হল। সেতো কোনও দিন এভাবে ভাবেনি ওদের কথা । বলল, ‘আদিবাসীদের ভাষা আপনি বোঝেন ?'
‘হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা। আমি তো ওদের সঙ্গে সেই ভাষাতেই কথা বলি। আবার বাংলাও শেখাই।'
‘কিছু কি শিখল ?'
‘ঠিক শিখেছে বলতে না পারলেও, বলা যায় শিখছে। আমি বলি যাদের তোমরা বাবু বল, তোমরা কিন্তু তাদেরই মতো মাইনে পাও। আবার এদিকে বাড়িটা ফ্রি, বেশ সুন্দর একটা ঘর সকলের, কিন্তু হলে হবে কী, ঝুপড়ি থেকে যে পাকা ঘরে এসেছে সেই বোধও তাদের নেই। তাছাড়া যেখানে সেখানে বাথরুম করে। আমি আস্তে আস্তে ওদের সব শেখাব । জীবনযাপনের তারতম্যেই যে মানুষ সভ্য হয় এটা ওদের জানানো দরকার । বেশি। টাকা দিলেই তো হল না, টাকাটা কীভাবে খরচ করলে মানুষ মনুষ্য পদবাচ্য হয়, সেটা তো আগে শেখাতে হবে ?'
অম্বুর কথা শুনে সীমন্ত অবাক হল। মনে মনে শ্রদ্ধা করল মেয়েটিকে। হয়তো বা কিছুটা আকর্ষণও বোধ করল। তা নইলে সেবার প্রবাসে ফিরে গিয়ে মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে করে অত উন্মনা হত না। ভাল বাংলা লিখতে পারে না। তবু চেষ্টা চরিত্র করে বাংলায় একটা চিঠিও লিখে ফেলেছিল, যেটা আর শেষে ডাকে দেওয়া হয়নি। যাবার আগের দিন পথে মুখোমুখি দেখা, হেসে বলল, ‘এমা, আপনি বেরিয়ে পড়েছেন ?'
‘কেন ?'
‘আমি যে আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।'
‘তবে চলুন ফিরে যাই।' সীমন্তও যে তাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল সে কথাটা আর বলল না।
অম্বু বলল, 'না, থাক। কোথায় যাচ্ছিলেন, হয়তো কোনও কাজে-'
'না না, এখানে আর আমার কী কাজ ! চলুন। আমিতো কালই চলে যাচ্ছি।'
‘সেই তো। মামুতো তাই বললেন। ওঁরা বলছিলেন আপনার মা-বাবার কত খারাপ লাগবে।'
একটু অভিযোগের সুরে সীমন্ত বলল, 'ওঁদের তো খারাপ লাগা উচিত নয়। ওঁরাই তো সাহেব বানাতে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে রেখেছেন। আমার কথা আপনার মনে থাকবে ?'
‘কেন থাকবে না, আমি কি বুদ্ধ না আমার স্মরণশক্তি বলে কিছু নেই !'
‘স্মরণশক্তির ছাঁকনিতে বাজে জিনিস সর্বদাই ফেলা যায় কি না।'
‘আপনি কিন্তু খুব ভাল বাংলা বলেন। এজন্য আপনাকে ক্রেডিট দিতেই হয়।'
‘বাংলাইতো আমার ভাষা। আমি সব সময় চেষ্টা করি ভুলে না যাই। ওখানে আমার তিনটে বাঙালি পরিবারের সঙ্গে যোগ আছে। তাদের সঙ্গে সব সময় বাংলা বলি, কিন্তু এখন মুশকিল ওরা আবার ইংরিজি বলে। বিশেষত ওদের মেয়ে।' ‘ওদের মেয়ে আছে বুঝি ?'
‘আপনার বয়সী।' একথা বলে সীমন্ত বোধহয় অম্বুর মনে একটু ঈর্ষা জাগাতে চেয়েছিল ।
অম্বু সে রাস্তায় পা দেবার মেয়েই নয়। বেজার মুখে বলল, 'আমার না এখানে একটাও মেয়ে বন্ধু নেই ! ওঁরা যদি এখানে থাকতেন কী ভাল হত।'
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দরজায় চলে এল ।
সীমন্ত তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
অম্বু বলল, ‘আপনি যেদিন এলেন, এ ঘরটা কিন্তু আমি গুছিয়ে দিয়েছিলাম। আপনার পছন্দ হয়েছিল ?'
‘তাই নাকি ? আপনি গুছিয়ে দিয়েছিলেন ?'
‘কাকিমা বলল, সমুর ঘরটা তুই গুছিয়ে দে। আমি তখন কী যত্ন করে গুছোলাম না—'
‘তাই এত সুন্দর লাগছিল ঘরটা।'
‘বাজে কথা। এতদিন কিছু না বলে যাবার আগের দিন বলা হচ্ছে সুন্দর লেগেছে। এদিকে আমি রোজ আশা করি কখন বলেন যে ঘরটা খুব সুন্দর গোছান ছিল।'
‘পাগল। আমি কি জানতাম নাকি কে গুছিয়েছে ? জানলে তো আমারই ভাল লাগত বেশি।' ‘কেন ?'
‘কেন আবার কী! আপনি গুছিয়েছেন তাই।'
‘আমি জানি সাহেবরা খুব মনরাখা কথা বলতে পারে।'
‘আমি কি সাহেব ?'
'ওরে বাবা। পাক্কা সাহেব। সাহেবদের চেহারাই আলাদা।'
‘সাহেবরা বুঝি খুব সুন্দর হয় ?'
‘দারুণ। কী ভাল লাগে দেখতে।'
‘আর আমাকে ?'
‘আপনাকে ? আপনি তো তাদের চেয়েও সুন্দর।'
‘ধন্যবাদ। এর চেয়ে সুখের কথা আর কী আছে আমার কাছে।'
‘আহা একথা যেন আমিই প্রথম বললাম।'
বলেই উঠে দাঁড়াল, ‘যাই দেখিগে, কাকু-কাকিমা কী করছেন।'
সীমান্ত বলল, 'প্লিজ আর একটু বসুন। কাকু কাকিমা তো আছেনই। আমি তো কাল ভোর না হতেই চলে যাব।'
‘আচ্ছা না গেলে কী হয় ?'
‘এতদিন যার জন্য রইলাম সেটা তো সমাপ্ত করতে হবে ?'
‘তাই তো। কিন্তু আবার আসতে তো সেই একবছর। বাবা, কত দেরি। হয়তো আর দেখাই হবে না।'
‘কেন ? কেন হবে না।' সীমন্ত একটা অস্থির জিজ্ঞাসা নিয়ে অম্বুর দিকে তাকাল।
অম্বু হাসল, কিছু বলল না।
সীমন্ত বলল, 'সেদিন তারপর কী হল ?'
‘কবে ? কোনদিন ?' 'ওই যে সবাই আপনার জন্য বর দেখতে গিয়েছিলেন ?'
‘মামণিতো আমার কানের কাছে রোজই তাদের প্রশংসা করে করে বধির করে দিলেন।'
'আর আপনি ?'
'আমি আবার কী ? মামণি বলেন আমি শুনি।'
‘নিজে কিছু স্থির করেননি ?'
‘তাতে একটু করেইছি। মামা-মামণি আমাকে যত বাচ্চা বা অপরিণত ভাবেন আমি তো সত্যিই তা নই ?'
'নিশ্চয়ই না।'
'তবে যদি কখনও আমার নিজের কাউকে ভাল লাগে, তখন না হয় দেখা যাবে।'
‘ঠিক বলেছেন। কিন্তু কারওকে কি আপনার আজ পর্যন্ত ভাল লাগেনি ?'
সীমন্তর মা ঘরে এলেন, ‘অম্বু, তোর মামণি তোকে ডেকে পাঠিয়েছে, জরুরি তলব। চলে যা তাড়াতাড়ি । অম্বু তৎক্ষণাৎ চলে গেল,
জবাবটা আর শোনা গেল না।
পরের দিন ভোর ছটায় প্লেন। যেমন আনতে গিয়েছিল তেমনই আবার ভোররাতে বিদায় দিতেও দু’বাড়ির লোক এয়ারপোর্টে গেল।
যাবার মুহূর্তে সীমন্ত একটু নিভৃতে অম্বুর হাতে আস্তে একটু চাপ দিয়ে বলল, 'আশা করি ভুলে। যাবেন না।'
অম্বু মুখ তুলল না, অস্ফুটে বলল, ‘আমিও কি সেটা আশা করতে পারি ?'
সীমন্ত দৃঢ়স্বরে বলল, 'নিশ্চয়ই।'
ঘন ঘন ঘোষণা শুনে এবার দৌড়তে হল সীমন্তকে। আর পরের বছর এসে দেখা গেল দুজনেই দুজনের কথা রেখেছে। কেউ কাউকে ভুলে যায়নি। এবং ভুলে না যাওয়াটা অনেকটা গভীরেই পৌঁছে গেল । যদিও অম্বু তখনও সুদূর। সীমন্তর অনেকদিনই মনে হয় অম্বুর বিষয়ে তার মন যেভাবে কাজ করে, অম্বুর মন সেদিকে নেই। অসহ্য রাগে তৎক্ষণাৎ ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। না চাইতে পাওয়া গেলে আপ্রাণ চেয়েও পাচ্ছে না এ অপমান সহ্য করতে পারে না।
সীমন্ত না জানলেও অম্বু জানত, এই রাজপুত্রকে সে কোনও দিনই পাবে না । সীমন্তর মা বাবার কল্পনায় সে কোথাও নেই। তাঁদের চিত্র তাঁরা এঁকেই রেখেছেন। মেয়ে গিরিডিতে আছে। যার বাবাকে সবাই মাইকাপ্রিন্স বলে। সীমন্ত একদিন বলল, ‘অম্বু তুমি চম্পানদী দেখেছ ?'
‘চম্পানদী ? কোথায় ? কতদূরে ? আমি তো জানি না।'
'যাবে ?'
সীমন্ত যে কবে থেকে অষুকে তুমি বলে, অম্বুও জানে না সীমন্তও জানে না। মনে মনে তুমিই ছিল, তাই বোধহয় আর আপনিটা
আসেনি মুখে । চুপ করে থেকে অম্বু বলল, ‘সবাই যাবে ?'
‘না, কেবল তুমি আর আমি।'
‘আপনি আর আমি ?'
‘তুমি আমাকে আপনি বলাটা ছাড়তে পার না?'
‘তাতে কী বা এসে যায়। আপনিই বলি, তুমিই বলি সবই সমান।'
'না সমান নয়। তুমিটা অনেক কাছের।'
অম্বু হাসল, ‘এক মাসের তো মেয়াদ। চোখের পলকে কখন কেটে যাবে। এর মধ্যেই তো দু সপ্তাহ কেটে গেল। তারপর আবার একবছর। কে কোথায় ভেসে যাব কে জানে।'
‘বাজে কথা বলতে তুমি খুব ভালবাস।'
‘কাকু কাকিমা তো বলছিলেন পরের বছর আর আপনি-'
‘উহুঁ, আর আপনি নয়, বল তুমি-'
'কথাটা শেষ করি ?'
'করো। কিন্তু আর আপনি বলবে না।'
কাকু-কাকিমা কী বলছিলেন ?
‘বলছিলেন আগামী বছর ওঁরাই যাবেন।'
‘আমার কাজ আর এক বছরেরই বাকি আছে। ওঁরা যান যাবেন, তাতে আমার আসা আটকাবে না। কাজ শেষ হলে আর একদিনও আমি থাকব না। অম্বু তুমি কি কিছু বোঝো না ? কাল চল চম্পানদীর ধারে যাই, এবার তোমার কাছ থেকে আমি একটা কথা নিয়ে যাবই ।'
‘সেটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না ?'
‘হোক। আমি গ্রাহ্য করি না।'
‘আমি করি।'
‘আমার সঙ্গে একা বেরোবার সাহস নেই তোমার ?'
‘মেয়েদের সাহসের পরিধি বড় কম। মা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই, বোন নেই, মামা-মামির কাছে প্রতিপালিত একটা মেয়ে আমি। আমার মামামামি যদিও আমার মা বাবার চাইতে আমার কাছে একবিন্দু কম নন, তাঁরা আমাকে সন্তানের অধিক ভালবাসেন তথাপি আমার অবস্থা বড় করুণ। সকলেই করুণা দেখায়। না, করুণার পাত্র আমি হব না। মরে গেলেও না।
‘এসব বাজে কথা বলছ কেন ? তুমিতো তুমিই, তোমার অস্তিত্বটাই আমার কাছে আসল। আমি তাছাড়া আর কিছু চাই না।'
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অম্বু বলল, 'চল, বাড়ি যাই। খুব সহজেই তার মুখ থেকে এই ‘তুমি’টা বেরিয়ে এল। আর হঠাৎ সীমন্ত যা কখনও করেনি সন্ধ্যার অন্ধকার নির্জনে অম্বুকে দুই হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে গভীর আবেগে চুম্বন করল। অম্বু জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। সীমন্ত বলল, ‘গণ্ডি এঁকে দিয়ে গেলাম, যাতে আর কেউ এ গণ্ডি না পেরোতে পারে।'
* বিগত পোষ্টে যে অনু উপন্যাসটি দেওয়া হয়েছিল, সেটা হল- 'পাতী অরণ্যের এক উপদেবতা- বাণী বসু' আপনারা চাইলে এখানে ক্লিক করে গল্পটি পড়তে পারেন।
পরের বছর কিন্তু সীমন্ত এল না। মা বাবাকেও যেতে বারণ করে চিঠি লিখল। এল প্রায় দেড় বছরের কাছাকাছি সময় পরে । একেবারে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত অবস্থায়। অ্যামেরিকার হুজুগ। হঠাৎ সেই হুজুগের ফাঁদে পা দিয়ে কোন বাবার শিষ্য হয়েছে। মাছ খায় না, মাংস খায় না, বুকে কালো কারে ঝুলোনো বাবার ছবি । শোবার ঘরের শিয়রে বাবার ফটো টাঙানো । এসে কয়েকদিনের মধ্যেই একটা কুটির বানিয়ে নিল। সেটা হল তার ধ্যানের জায়গা। ছেলের এই ভাব দেখে ছেলের মা-বাবা অম্বুর মামা মামি সর স্তম্ভিত।
অম্বু এসে বলল, 'এ আবার তমি কী ভাব ধরেছ ? ওসব বাবা-টাবায় তুমি বিশ্বাস কর নাকি ?' সীমন্ত বেশ গম্ভীর হয়ে কিঞ্চিৎ তিরস্কারের সুরে বলল, 'ছেলেমানুষি কোরো না। যা বোঝে না তা নিয়ে কথা বাোলো না।' অম্বু ঘাবড়ায় না, হাসে। অম্বুর মুখের দিকে তাকায় না সীমন্ত। মনে মনে ভাবে এইসব শত্রুর জন্যই ব্যাঘাত ঘটে। এই মানুষটার উপর কেন যে সে কঠোর হতে পারে না কে জানে। মুখের দিকে পর্যন্ত তাকাতে পারে না।
কয়েক দিন পর থেকে বলতে গেলে সেই নতুন তৈরি কুটিরটার মধ্যেই বেশি সময় কাটাতে লাগল। কে জানে হয়তো বা অম্বুর ভয়েই। ছেলেকে সাহেব বানাতে গিয়ে এ কী হল ? কী দুঃখে সে সন্ন্যাস গ্রহণ করল ! মা-বাবা এ নিয়ে সারাদিন কান্নাকাটি করছেন। মা তো প্রায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছেন। সেদিকে সে তাকিয়েও দেখে না। ঠিক করেছে কিছুদিন এখানে কাটিয়ে হৃষীকেশে চলে যাবে। সেখানেই শুরু হবে তার কাজ। বাবা তাকে প্রচার কার্যে নিয়োগ করেছেন। বলেছেন,'তুই গৌরাঙ্গ, মর্তভূমিতে মানুষরূপে এই অস্থির পৃথিবীকে শান্ত করতে এসেছিস। ছোট সংসারের ছোট জীবন তোর জন্য নয়। লোকে তোকে দেখেই বুঝতে পারবে সে কথা।' সে কথা মিথ্যে নয় । লম্বা গেরুয়া গাউনটা পরে যখন সে দাঁড়ায়, এত সুন্দর দেখায়,বিশ্বাস করতে দ্বিধা হয় না ইনি সত্যিই সেই গৌরাঙ্গ, মানুষরূপে জন্ম নিয়েছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। সত্যি বলতে তার নিজের মা বাবা পর্যন্ত ছেলেকে এই পোশাকে, এই চেহারায় দেখে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে যান, কষ্টও হয়, ভক্তিও হয়। সকলেই তাকে এই পোশাকে দেখে নম্র হয়ে ওঠে। ওঠে না শুধু অম্বু। যখন তখন আসে, হেসে বলে ‘ঠাকুরমশাই,হৃষীকেশ যাবেন যদি তো সোজা চলে গেলেই পারতেন, আবার এখানে এলেন কেন ?' ঠাকুরমশাই জবাব দেন না, তাকান না।
অম্বু একাই কথা বলে, 'মেয়েদের দিকে তাকালেই যদি ব্রত ভঙ্গ হয়ে যায় তবে আর ভণ্ডামি করে লাভ কী ?'
সন্ন্যাসীর মুদ্রিত চক্ষু মুদ্রিতই থাকে। আবার বলে, 'আমার শুধু। একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে, এদিকে একটু ফেরো না, মুখের দিকে না তাকালে কি কথা বলা যায় ?'
সন্ন্যাসী নিরুত্তর। তারপর সন্ন্যাসের স্থান কুটিরে স্থানান্তরিত হল। সেখানেও নির্বিচারে অম্বু যাওয়া ধরল। একদিন দেখা গেল। কুটিরের নিচু দরজার মাথায় লেখা মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। এই লেখা দেখে অম্বুর সত্যি হাসি পেল। এবং সেই নিষেধও সে গ্রাহ্য না করে ঢুকে গেল ভিতরে। সীমন্ত এমনই চুপচাপ বসেছিল। অম্বুকে দেখে ভুরু কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। অম্বু বলল, ‘জানি বিরক্ত হচ্ছ , কিন্তু আমি আসবই। না এসে পারব না বলেই আসব। আমি বলি কি তুমি হৃষীকেশ চলে যাও। সকলের চোখের সামনে একটা যন্ত্রণার কাঁটা হয়ে না থেকে চলে যাওয়াই ভাল। কাকু-কাকিমা কেঁদে ভাসাচ্ছেন, দেখতে ভাল লাগছে তোমার ?'
ব্রহ্মচারী সীমন্ত বলল, 'দরজার লেখাটা কি চোখে পড়েছে ?'
‘পড়েছে।'
‘তবে ?'
'তবে আবার কী ? আমি এখনও মহিলা হইনি। তাছাড়া ওটা আমি ছিড়ে ফেলেছি।'
'কী স্পর্ধা!'
‘ঈশ্বরকে যদি কেউ পেতে চায়,অবশ্য তিনি যদি থেকে থাকেন, তা হলে তাঁর কাছে নারীপুরুষের একটাই নাম হওয়া উচিত যার নাম মানুষ। এটুকুও যদি না বুঝে থাকো তাহলে ওই গেরুয়া আলখাল্লাটা ছেড়ে স্বাভাবিক-' ‘আমি চাই না কেউ আমাকে এখানে এসে বিরক্ত করে।'
‘আমিতো শুনেছি, তোমার গুরুদেবের দশখানা গাড়ি, আমেরিকার কোনও শহরে প্রাসাদোপম বাড়ি, পায়ে হিরে খচিত জুতো আর নারীকুল অঙ্গের ভূষণ-'
‘উঃ অসহ্য।' সাধু সীমন্ত তার কুটিরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। অনেক পরে যখন খুলল তখন অম্বু চলে গেছে। সেই রাত্রে সীমন্ত ঘুমোতে পারল না। এবং ভেবে ভেবে ঠিক করল, না, আর এখানে নয়, চলেই যেতে হবে। গুরুদেবের আদেশে এখন তার সংযমের পিরিয়ড চলছে, সংসারে থেকেও কচুপাতার জলের মতো ভেসে থাকার অভ্যাস চলছে, কিন্তু আর সব পারলেও একটা জায়গায় এসে বারে বারে ঠোক্কর খাচ্ছে। কথা যে শুনবে না তাকে নিয়ে সে কী করে ? কিন্তু যেদিন শুনল অম্বুরা চিরতরে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে, সেদিন তার ধ্যান জ্ঞান প্রার্থনা উপাসনা সহিষ্ণুতা অধৈর্যহীনতা সব যেন তাকে ছেড়ে যেতে চাইল । কুটির ছেড়ে অসময়ে চলে এল নিজের ঘরে, বসে রইল জানলা দিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেই সময়ে কেউ বাড়ি ছিল না। কেন নেই সেটা সে জানে। অম্বুদের বিদায় দিতে গেছেন। একটু বেলায় টের পেল ফিরে এসেছেন তাঁরা। ওরা চলে গেছে। সেদিন আর ঘর থেকে বেরলে না, কুটিরে গেল না, ধীরে ধীরে আপন লয়ে চলতে চলতে বেলা বয়ে গেল, বিকেল হল, সন্ধ্যা হল, রাত্রি এল, সীমন্ত ঠায় বসে রইল তার মাটিতে পাতা শক্ত বিছানায়। মা দুবার ঘরে এসেছিলেন খাবার দিতে। মায়ের মুখেও কোনও কথা ছিল না, ছেলের মুখেওনা। বসে থাকতে থাকতে অনেক রাত্রে কখন যেন ঘুমে ঢলে পড়েছিল। হঠাৎ মনে হল বাড়িতে যেন কী একটা হয়েছে। সব ঘরে আলো জ্বলছে, গাড়ি বেরোচ্ছে গ্যারেজ থেকে, ড্রাইভারের ঘর থেকে ড্রাইভারকে ডেকে আনা হচ্ছে, তারপর হুশ করে বেরিয়ে গেল গাড়ি। দরজা খুলে সীমন্ত যাকে সামনে পেল তাকেই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ? গাড়ি করে কে গেল ? নতমুখে পুরনো পরিচারিকা বলল 'তোমার মা আর বাবা গেলেন। ও বাড়িতে খুব বিপদ।'
‘কোন বাড়িতে ?'
‘অম্বুদিদিদের বাড়িতে।'
‘ওরা চলে যায়নি ?'
‘না। যেতে পারেনি, অম্বুদিদির যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে আজ আসবে বলে জানিয়েছিল।'
‘তারপর ?'
'তারপর যাওয়াটা বাদ দিতে হয়েছে। অনেক রাত্রে একটা গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মামিমা অম্বুদিদির ঘরে যান। গিয়েই বুঝতে পারেন অম্বুদিদি বিষ খেয়েছে। তক্ষুনি মামা-মামিমা এখানে খবর পাঠান। সঙ্গে সঙ্গে তোমার মা বাবা চলে গেলেন।
আর কোনও প্রশ্ন করল না সীমন্ত। ঠিক আগের মতো শার্ট প্যান্ট পরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, 'দরজা বন্ধ করে দাও।' রাস্তায় নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল সে। গিয়ে দেখল মামি গলায় আঙুল দিয়ে বমি করাবার চেষ্টা করছেন, সীমন্তর বাবা বলছেন ওকে ঘুমিয়ে পড়তে দেবেন না, যে করে হোক জাগিয়ে রাখুন। মামা বলছেন ‘অম্বু, মা আমার ! সোনা আমার ! আমি আর কখনও তোমার উপর কোনও জোর খাটাব না।' কাঁদছেন হাউ হাউ করে। তারই মধ্যে শার্ট প্যান্ট পরা আগের সীমন্তকে দেখে সবাই থমকাল। সীমন্ত বলল, ‘ওতে হবে না, এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, পেট ওয়াশ করতে হবে।' বলতে বলতেই পাঁজা কোলে করে অম্বুকে তুলে নিয়ে গাড়ির সিটে বসিয়ে নিজে উঠে বসল। বলল, ‘আপনাদের আর আসতে হবে না। আমি থাকব ওখানে।'
গাড়ি ঝড়ের গতি নিয়ে চলে গেল শহরের দিকে। সীমন্ত অম্বুর ঘুমে ঢলেপড়া মাথাটা বারে বারে তুলে দিয়ে বলতে লাগল ‘জেগে থাকতে চেষ্টা করো অম্বু। এ তুমি কী করলে ?' অতি দ্রুতই গাড়ি পৌছে গেল হাসপাতালে, ব্যবস্থা হতেও দেরি হল না। তিনদিন বাদে মামা-মামি গিয়ে সুস্থ মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন।
বিকেলে সীমন্ত দেখতে এল । অম্বুর মুখে আগের মতোই সেই সরল হাসি, সেই রকমই কথা বলার ভঙ্গি, ‘এই যে সন্ন্যাসী ঠাকুর, এ কী পোশাক আপনার ? এই পোশাকে আপনি হৃষীকেশ যেতে পারবেন তো?'
সীমন্ত বলল, ‘দিব্যি একখানা নাটক করে উঠলে।'
‘তা কী করব। গণ্ডি কেটে দিয়ে গেল লোকটা, আর পরিজনেরা টানাটানি করছেন বেরিয়ে আসবার জন্য। অন্য পন্থা কী আছে ভেবে পেলাম না।' ঝরঝর করে হাসতে, লাগল। তারপরই হঠাৎ দুহাতে ঢেকে ফেলল মুখটা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে দুই গাল বেয়ে জলের ধারা নামল। অম্বুর মতো পরিহাস প্রিয়মেয়ের সঙ্গে আবেগের এই প্রকাশ ঠিক মিলল না। ঝুঁকে পড়ে হাত দুটো মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে সামন্ত বলল 'এই বহুমূল্য রত্ন এই গণ্ডিতে রাখা আর সত্যি নিরাপদ নয়, আর আমি ভুল করব না। এই সুন্দর পৃথিবীতে এই সুন্দর ভালবাসা তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর আমি কী পাব আমার সন্ন্যাসে ? আমার হাতটা তুমি ধরো অম্বু, আর যেন আমি হুজুগে মেতে কোনও ভুলপথে পা না বাড়াই।' একটু হেসে চারদিকে সাবধানে তাকিয়ে আবার একটি গণ্ডি এঁকে দিল বুকের মধ্যে মুখটা নিয়ে।
---সমাপ্ত---
আরো গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করবেন।
গল্পটির পিডিএফ সংগ্রহ করবেন।
পাঠকগণ, 'সীমান্তর সন্ন্যাস - প্রতিভা বসু' এই বাংলা রোমান্টিক অণু-উপন্যাসটি পিডিএফ আকারেও সংগ্রহ করতে পারেন।
অম্বু এসে বলল, 'এ আবার তমি কী ভাব ধরেছ ? ওসব বাবা-টাবায় তুমি বিশ্বাস কর নাকি ?' সীমন্ত বেশ গম্ভীর হয়ে কিঞ্চিৎ তিরস্কারের সুরে বলল, 'ছেলেমানুষি কোরো না। যা বোঝে না তা নিয়ে কথা বাোলো না।' অম্বু ঘাবড়ায় না, হাসে। অম্বুর মুখের দিকে তাকায় না সীমন্ত। মনে মনে ভাবে এইসব শত্রুর জন্যই ব্যাঘাত ঘটে। এই মানুষটার উপর কেন যে সে কঠোর হতে পারে না কে জানে। মুখের দিকে পর্যন্ত তাকাতে পারে না।
কয়েক দিন পর থেকে বলতে গেলে সেই নতুন তৈরি কুটিরটার মধ্যেই বেশি সময় কাটাতে লাগল। কে জানে হয়তো বা অম্বুর ভয়েই। ছেলেকে সাহেব বানাতে গিয়ে এ কী হল ? কী দুঃখে সে সন্ন্যাস গ্রহণ করল ! মা-বাবা এ নিয়ে সারাদিন কান্নাকাটি করছেন। মা তো প্রায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছেন। সেদিকে সে তাকিয়েও দেখে না। ঠিক করেছে কিছুদিন এখানে কাটিয়ে হৃষীকেশে চলে যাবে। সেখানেই শুরু হবে তার কাজ। বাবা তাকে প্রচার কার্যে নিয়োগ করেছেন। বলেছেন,'তুই গৌরাঙ্গ, মর্তভূমিতে মানুষরূপে এই অস্থির পৃথিবীকে শান্ত করতে এসেছিস। ছোট সংসারের ছোট জীবন তোর জন্য নয়। লোকে তোকে দেখেই বুঝতে পারবে সে কথা।' সে কথা মিথ্যে নয় । লম্বা গেরুয়া গাউনটা পরে যখন সে দাঁড়ায়, এত সুন্দর দেখায়,বিশ্বাস করতে দ্বিধা হয় না ইনি সত্যিই সেই গৌরাঙ্গ, মানুষরূপে জন্ম নিয়েছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। সত্যি বলতে তার নিজের মা বাবা পর্যন্ত ছেলেকে এই পোশাকে, এই চেহারায় দেখে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে যান, কষ্টও হয়, ভক্তিও হয়। সকলেই তাকে এই পোশাকে দেখে নম্র হয়ে ওঠে। ওঠে না শুধু অম্বু। যখন তখন আসে, হেসে বলে ‘ঠাকুরমশাই,হৃষীকেশ যাবেন যদি তো সোজা চলে গেলেই পারতেন, আবার এখানে এলেন কেন ?' ঠাকুরমশাই জবাব দেন না, তাকান না।
অম্বু একাই কথা বলে, 'মেয়েদের দিকে তাকালেই যদি ব্রত ভঙ্গ হয়ে যায় তবে আর ভণ্ডামি করে লাভ কী ?'
সন্ন্যাসীর মুদ্রিত চক্ষু মুদ্রিতই থাকে। আবার বলে, 'আমার শুধু। একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে, এদিকে একটু ফেরো না, মুখের দিকে না তাকালে কি কথা বলা যায় ?'
সন্ন্যাসী নিরুত্তর। তারপর সন্ন্যাসের স্থান কুটিরে স্থানান্তরিত হল। সেখানেও নির্বিচারে অম্বু যাওয়া ধরল। একদিন দেখা গেল। কুটিরের নিচু দরজার মাথায় লেখা মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। এই লেখা দেখে অম্বুর সত্যি হাসি পেল। এবং সেই নিষেধও সে গ্রাহ্য না করে ঢুকে গেল ভিতরে। সীমন্ত এমনই চুপচাপ বসেছিল। অম্বুকে দেখে ভুরু কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। অম্বু বলল, ‘জানি বিরক্ত হচ্ছ , কিন্তু আমি আসবই। না এসে পারব না বলেই আসব। আমি বলি কি তুমি হৃষীকেশ চলে যাও। সকলের চোখের সামনে একটা যন্ত্রণার কাঁটা হয়ে না থেকে চলে যাওয়াই ভাল। কাকু-কাকিমা কেঁদে ভাসাচ্ছেন, দেখতে ভাল লাগছে তোমার ?'
ব্রহ্মচারী সীমন্ত বলল, 'দরজার লেখাটা কি চোখে পড়েছে ?'
‘পড়েছে।'
‘তবে ?'
'তবে আবার কী ? আমি এখনও মহিলা হইনি। তাছাড়া ওটা আমি ছিড়ে ফেলেছি।'
'কী স্পর্ধা!'
‘ঈশ্বরকে যদি কেউ পেতে চায়,অবশ্য তিনি যদি থেকে থাকেন, তা হলে তাঁর কাছে নারীপুরুষের একটাই নাম হওয়া উচিত যার নাম মানুষ। এটুকুও যদি না বুঝে থাকো তাহলে ওই গেরুয়া আলখাল্লাটা ছেড়ে স্বাভাবিক-' ‘আমি চাই না কেউ আমাকে এখানে এসে বিরক্ত করে।'
‘আমিতো শুনেছি, তোমার গুরুদেবের দশখানা গাড়ি, আমেরিকার কোনও শহরে প্রাসাদোপম বাড়ি, পায়ে হিরে খচিত জুতো আর নারীকুল অঙ্গের ভূষণ-'
‘উঃ অসহ্য।' সাধু সীমন্ত তার কুটিরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। অনেক পরে যখন খুলল তখন অম্বু চলে গেছে। সেই রাত্রে সীমন্ত ঘুমোতে পারল না। এবং ভেবে ভেবে ঠিক করল, না, আর এখানে নয়, চলেই যেতে হবে। গুরুদেবের আদেশে এখন তার সংযমের পিরিয়ড চলছে, সংসারে থেকেও কচুপাতার জলের মতো ভেসে থাকার অভ্যাস চলছে, কিন্তু আর সব পারলেও একটা জায়গায় এসে বারে বারে ঠোক্কর খাচ্ছে। কথা যে শুনবে না তাকে নিয়ে সে কী করে ? কিন্তু যেদিন শুনল অম্বুরা চিরতরে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে, সেদিন তার ধ্যান জ্ঞান প্রার্থনা উপাসনা সহিষ্ণুতা অধৈর্যহীনতা সব যেন তাকে ছেড়ে যেতে চাইল । কুটির ছেড়ে অসময়ে চলে এল নিজের ঘরে, বসে রইল জানলা দিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেই সময়ে কেউ বাড়ি ছিল না। কেন নেই সেটা সে জানে। অম্বুদের বিদায় দিতে গেছেন। একটু বেলায় টের পেল ফিরে এসেছেন তাঁরা। ওরা চলে গেছে। সেদিন আর ঘর থেকে বেরলে না, কুটিরে গেল না, ধীরে ধীরে আপন লয়ে চলতে চলতে বেলা বয়ে গেল, বিকেল হল, সন্ধ্যা হল, রাত্রি এল, সীমন্ত ঠায় বসে রইল তার মাটিতে পাতা শক্ত বিছানায়। মা দুবার ঘরে এসেছিলেন খাবার দিতে। মায়ের মুখেও কোনও কথা ছিল না, ছেলের মুখেওনা। বসে থাকতে থাকতে অনেক রাত্রে কখন যেন ঘুমে ঢলে পড়েছিল। হঠাৎ মনে হল বাড়িতে যেন কী একটা হয়েছে। সব ঘরে আলো জ্বলছে, গাড়ি বেরোচ্ছে গ্যারেজ থেকে, ড্রাইভারের ঘর থেকে ড্রাইভারকে ডেকে আনা হচ্ছে, তারপর হুশ করে বেরিয়ে গেল গাড়ি। দরজা খুলে সীমন্ত যাকে সামনে পেল তাকেই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ? গাড়ি করে কে গেল ? নতমুখে পুরনো পরিচারিকা বলল 'তোমার মা আর বাবা গেলেন। ও বাড়িতে খুব বিপদ।'
‘কোন বাড়িতে ?'
‘অম্বুদিদিদের বাড়িতে।'
‘ওরা চলে যায়নি ?'
‘না। যেতে পারেনি, অম্বুদিদির যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে আজ আসবে বলে জানিয়েছিল।'
‘তারপর ?'
'তারপর যাওয়াটা বাদ দিতে হয়েছে। অনেক রাত্রে একটা গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মামিমা অম্বুদিদির ঘরে যান। গিয়েই বুঝতে পারেন অম্বুদিদি বিষ খেয়েছে। তক্ষুনি মামা-মামিমা এখানে খবর পাঠান। সঙ্গে সঙ্গে তোমার মা বাবা চলে গেলেন।
আর কোনও প্রশ্ন করল না সীমন্ত। ঠিক আগের মতো শার্ট প্যান্ট পরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, 'দরজা বন্ধ করে দাও।' রাস্তায় নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল সে। গিয়ে দেখল মামি গলায় আঙুল দিয়ে বমি করাবার চেষ্টা করছেন, সীমন্তর বাবা বলছেন ওকে ঘুমিয়ে পড়তে দেবেন না, যে করে হোক জাগিয়ে রাখুন। মামা বলছেন ‘অম্বু, মা আমার ! সোনা আমার ! আমি আর কখনও তোমার উপর কোনও জোর খাটাব না।' কাঁদছেন হাউ হাউ করে। তারই মধ্যে শার্ট প্যান্ট পরা আগের সীমন্তকে দেখে সবাই থমকাল। সীমন্ত বলল, ‘ওতে হবে না, এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, পেট ওয়াশ করতে হবে।' বলতে বলতেই পাঁজা কোলে করে অম্বুকে তুলে নিয়ে গাড়ির সিটে বসিয়ে নিজে উঠে বসল। বলল, ‘আপনাদের আর আসতে হবে না। আমি থাকব ওখানে।'
গাড়ি ঝড়ের গতি নিয়ে চলে গেল শহরের দিকে। সীমন্ত অম্বুর ঘুমে ঢলেপড়া মাথাটা বারে বারে তুলে দিয়ে বলতে লাগল ‘জেগে থাকতে চেষ্টা করো অম্বু। এ তুমি কী করলে ?' অতি দ্রুতই গাড়ি পৌছে গেল হাসপাতালে, ব্যবস্থা হতেও দেরি হল না। তিনদিন বাদে মামা-মামি গিয়ে সুস্থ মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন।
বিকেলে সীমন্ত দেখতে এল । অম্বুর মুখে আগের মতোই সেই সরল হাসি, সেই রকমই কথা বলার ভঙ্গি, ‘এই যে সন্ন্যাসী ঠাকুর, এ কী পোশাক আপনার ? এই পোশাকে আপনি হৃষীকেশ যেতে পারবেন তো?'
সীমন্ত বলল, ‘দিব্যি একখানা নাটক করে উঠলে।'
‘তা কী করব। গণ্ডি কেটে দিয়ে গেল লোকটা, আর পরিজনেরা টানাটানি করছেন বেরিয়ে আসবার জন্য। অন্য পন্থা কী আছে ভেবে পেলাম না।' ঝরঝর করে হাসতে, লাগল। তারপরই হঠাৎ দুহাতে ঢেকে ফেলল মুখটা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে দুই গাল বেয়ে জলের ধারা নামল। অম্বুর মতো পরিহাস প্রিয়মেয়ের সঙ্গে আবেগের এই প্রকাশ ঠিক মিলল না। ঝুঁকে পড়ে হাত দুটো মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে সামন্ত বলল 'এই বহুমূল্য রত্ন এই গণ্ডিতে রাখা আর সত্যি নিরাপদ নয়, আর আমি ভুল করব না। এই সুন্দর পৃথিবীতে এই সুন্দর ভালবাসা তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর আমি কী পাব আমার সন্ন্যাসে ? আমার হাতটা তুমি ধরো অম্বু, আর যেন আমি হুজুগে মেতে কোনও ভুলপথে পা না বাড়াই।' একটু হেসে চারদিকে সাবধানে তাকিয়ে আবার একটি গণ্ডি এঁকে দিল বুকের মধ্যে মুখটা নিয়ে।
---সমাপ্ত---
আরো গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করবেন।
গল্পটির পিডিএফ সংগ্রহ করবেন।
পাঠকগণ, 'সীমান্তর সন্ন্যাস - প্রতিভা বসু' এই বাংলা রোমান্টিক অণু-উপন্যাসটি পিডিএফ আকারেও সংগ্রহ করতে পারেন।
No comments:
Post a Comment