সরস গল্প- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলা ডিজিটাল বই পিডিএফ - বাংলা বই এর pdf ডাউনলোড-Bangla Digital Boi Pdf

Latest

Tuesday, July 17, 2018

সরস গল্প- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলা ডিজিটাল বই পিডিএফ


সরস গল্প- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলা ডিজিটাল বই পিডিএফ
ডিজিটাল বইয়ের নাম- সরস গল্প
লেখক- বিভিন্ন
সম্পাদিত- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ৪৪২
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ৩০এমবি
জলছাপমুক্ত, ঝকঝকে প্রিন্ট

"To laugh at fate through life's short span
Is the prerogative of man."
ষোড়শ শতাব্দীতে হাসির এই সুমহান ভূমিকার কথা বলেছিলেন র্যাবলে। হাসি মানুষের মানসিক ব্যাধিকে দূর করে—দুৰ্ভাগ্যকে জয় করে উপরে ওঠাবার শক্তি দেয়, এনে দেয় বুকভরা স্বাস্থ্য। যে হাসতে জানে না, সে বাঁচতেও জানে না । কোনো ব্যক্তি মানুষ সম্বন্ধে এ যেমন সত্য, কোনো জাতি সম্বন্ধেও ঠিক তেমনি সত্য। র্যাবলে যে হাসির কথা বলেছেন তা হল বেপরোয় উদ্দাম অট্টহাসি। তার জন্যে চাই মোহমুক্তি, জীবন সম্পর্কে, জগৎ সম্বন্ধে একটা দার্শনিক বিচ্ছিন্নতার মনোভাব। উপমা দিয়ে বলা যাক, একটা ঘরের মধ্যে বসে আছি। আর জানলার কাচের ভেতর দিয়ে দেখছি বাইরের মানুষগুলোকে । কাচটার বিশেষত্ব আছে ; তার ভেতর দিয়ে যা দেখছি কিছুই স্বাভাবিক নয়, সব কেমন আঁকাবঁকা, ভাঙাচুরো, উলটো-পালটা-সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না সব কিছু এক বিচিত্ৰ প্ৰহসন ; নিজেকেও সেই প্ৰহসন থেকে বাদ দিচ্ছি না। জানলার বাইরে থেকে যারা আমাকে দেখছে—তারা হয়তো দেখতে পাচ্ছে। আমি শূন্যে পা দিয়ে ঝুলে আছি, আমার কপালের উপর দুটো কান গজিয়েছে। সব অস্বাভাবিক, সব হাস্যকর-নিজের অস্তিত্বটাও সেই শোভাযাত্রায় পা ফেলেছে। দুঃখ মিথ্যে, দুর্ভাবনা অবাস্তর। কালের প্রচণ্ড ছুটন্ত স্রোতে ফুটন্ত ফেনার হাসির মতো ধেয়ে যাক জীবন ; দুঃখ-দুবিপাক যদি কখনো একআধটু বিপৰ্যয় ঘটিয়েই বসে, তা হলে এই বলে সান্তনা দাও নিজেকে :
"Life is quite an unpleasant business but it is not so very hard to make it wonderful... when your matches suddenly go off in your pocket rejoice and offer thanks to heaven that your pocket is not a gun-powder magazine. When your relations come to pay you a visit during your holiday in the country, don't get pale but exclaim triumphantly, How very lucky it's not the police...If you are flogged with a birch rod, kick your legs in rapture and exclaim, How very happy I am that I am not being flogged by nettles!"
জীবন যে অতি মনোহর, এইটি প্ৰমাণ করবার জন্যে কথাগুলি লিখেছিলেন তরুণ আন্তন চেকভ। র্যাবলের হাসিতত্ত্বের মর্মট এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। সংসার যেমন ভাবে আছে- তাকে সেইভাবেই গ্ৰহণ করো ; যতটুকু পেয়েছ তার চাইতে বেশি পাওয়ার কোনো দরকার নেই-এর চাইতে অনেক কমও তো তুমি পেতে পারতে ; লটারির টিকেট কিনো না-তা হলেই আর না-পাওয়ার মনঃক্ষোভের কারণ থাকবে না। আর এই মানসিক প্রশাস্তিতে পৌছে-- অট্টহাসিতে সমস্ত ক্ষয়-ক্ষতি ভয়-ভাবনার অবসান ঘটাও । মানুষকে এই নির্বিকার হাসির মন্ত্রই দিয়েছেন র্যাবলে—এরই দার্শনিক নাম 'পাতা গ্রুয়েলিজম' ।
কিন্তু এ হাসির অধিকার সকলের জন্যে নয়। সবাই এমনভাবে আঘাতকে তুচ্ছ করতে পারে না, এমন করে ক্ষতি-দুঃখ-পরাজয়ের গ্লানিকে ভুলতে পারে না ; ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যথা-ব্যর্থতা-অপমান তাদের ক্ষত-বিক্ষত করে। আর তাদেরই কেউ কেউ ক্ৰোধ-কান্না-অভিশাপকে এক অদ্ভুত হাসিতে রূপান্তরিত করে দেয়। সে হাসি আমাদের আচমকা চাবুক মারে—রক্তের মধ্যে জ্বালা ধরায়, সে হাসিতে লুকিয়ে থাকে সাপের বিষ । সে হাসি হোসেছেন জোনাথান সুইফটু, চার্লস ল্যাম, কমলাকান্তের দপ্তরের বঙ্কিমচন্দ্ৰ ।
আয়ার্ল্যাণ্ডের শোষণ ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতি আকৃত্রিম মমতা নিয়ে শোষক সমাজের প্রতি অসহ্য ঘূণায়, এই হাসির ভয়ালতম নমুনা রেখে গেছেন সুইফট্ :
"A child will make two dishes at an entertainment of friends; and when the family dines alone, the fore or hind quarter will make a reasonable dish, and seasoned with a little pepper or salt will be very good boiled on the fourth day, especially in winter. ...I grant this food will be somewhat dear, and therefore very proper for landlords, who, as they have already devoured most of the parents, seem to have the best title for the children !'

সমালোচকেরা বলেছেন-সুইফটের এই রচনা বেরিয়ে এসেছে পৈশাচিকত থেকে, এর চাইতে বীভৎস অমানুষিক হাসি আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ হাসেনি। কিন্তু সেদিনের আয়ার্ল্যাণ্ডের ইতিহাস যারা জানেন, তাঁৱা জানেন - লক্ষ লক্ষ ক্ষুধিত অত্যাচারিত মানুষের প্রাণের জ্বালা ফোটাতে গিয়ে এভাবে ছাড়া সুইফটু হাসতে পারেননি। চার্লস ল্যামের ব্যক্তিজীবনের সমস্ত নৈরাশ্য আর ব্যর্থতাবোধও এমনিভাবে হাসির মধ্য দিয়ে আত্মপ্ৰকাশ করতে চেয়েছে-‘কমলাকাস্তের দপ্তরে’ও হাসির আবরণের তলায় টলটল করছে কান্নার মুক্তো।
এ-ছাড়া আর একটি হাসি আছে ।
সে হাসিতে দর্শন নেই-কোনো ব্যক্তিক-সামাজিক-রাষ্ট্রক অন্তগুঢ় যন্ত্রণাকেও তা বহন করছে না। তা প্ৰতিদিন প্ৰতি মুহুর্তে জলের উপর সূর্যের আলোর মতো চিকচিক করে জ্বলে। জীবনের ছন্দে কোথাও একটু পতন ঘটলেই সঙ্গতিবোধে আঘাত লাগে-তখনই এই হাসি উছলে ওঠে; কথার ভুল, চোখের ভুল, মনের ভুল, যে-কোনো আতিশয্য-এরা সবাই-ই এই হাসির উপকরণ । বাতিকগ্রস্তকে চটিয়ে দিয়ে এ হাসি উৎসারিত হয়-এ হাসি থাকে মোটা মানুষের পা পিছলে পড়ার ভেতর-এ হাসি আসে অপ্রত্যাশিত যোগাযোগে, এর আবির্ভাব ঘটে সম্পূর্ণ দুটি বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য খুজে পাওয়াতে । প্ৰশ্বাসে প্ৰশ্বাসে অক্সিজেন টেনে নেওয়ার মতো এই হাসিই আমাদের স্বাস্থ্য আনে --ক্লাস্তিকর দিনযাত্রাকে বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তোলে-পরম দুঃখের মুহুর্তেও এ হাসি মনে করিয়ে দেয় ; সব কিছুই শূন্য হয়ে যায়নি। সংসার থেকে- 'এখনো অনেক রয়েছে বাকি ৷' কখনো এ রঙ্গে উতরোল - কখনো বা চতুর কৌতুকে দীপ্ত। রাম-শ্যাম-যদু, টম-ডিক-হারী চেতন অচেতনভাবে এ হাসিকে মুহুর্তে মুহুর্তে সৃষ্টি করে চলে।
নতুন ছাত্র হারীকে ক্লাস-টিচার প্রশ্ন করেন ; তোমার নাম কী ?
উত্তর আসে ; হারী রবিনসন।
ক্লাস-টিচার ভ্ৰকুটি করেন : শিক্ষককে কিছু বলতে হলে তার সঙ্গে স্যার বলতে হয়। এইবার ঠিক করে বলে, তোমার নাম কী ?
জবাব আসে : স্যার হারী রবিনসন।
এইবারে ক্লাস-টিচারের নিঃশব্দ হওয়ার পালা ।
আমাদের বাংলা সাহিত্যে র্যাবলেপন্থী হাসির সন্ধান মেলে না-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘হাসির গানে’তার অল্প স্বল্প আভাস হয়তো আছে। সুকুমার রায় যখন “এই দুনিয়ার সকল ভালো” দেখতে দেখতে শেষ পর্যন্ত 'পাউরুটি আর ঝোলা গুড়ে' পরম প্ৰাপ্যটি দেখতে পান-তখন এর একটি চকিত-চমক আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু দর্শনে চাৰ্বাক থাকলেও এ হাসি আমাদের জীবনে নেই ; অন্তত বাঙালী লেখকদের কলমে এ বস্তু কখনো ফুটে ওঠেনি। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ব্যক্তি কৌতুক এবং সমাজ কৌতুক পার হয়ে আমরা যখন রামমোহন রায়ের ঘাটে এসে পৌছোই-তখন বাংলাদেশে পশ্চিমী রাজতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির অভূ্যদয়। রামমোহন সেই সন্ধিকালে দাড়িয়ে পুর্ব-পশ্চিমের মধ্যে সেতু রচনার চেষ্টা করছেন। আকাশে বাতাসে তখনো ভারতচন্দ্রের হাসি কলঝংকৃত, কবিগানের ক্ষীণ রেশ তখনো শোনা যায়, দাশরথির কৌতুক তখনো জীবন্ত । কিন্তু রামমোহনের কাল নতুনতর কৌতুকের জন্যেই প্ৰতীক্ষা করছিল।
একদিকে প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীলতা, অন্যদিকে খ্ৰীষ্টধর্মপ্রচারে অত্যুৎসাহী মিশনারীর দল-এই দুই প্ৰবল প্রতিপক্ষের মধ্য দিয়ে মুক্তবুদ্ধি রামমোহনকে পথ কাটতে হয়েছে। ফলে তার সমস্ত জীবনটাই নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস । আলোচনায় ও বিচারে স্বভাবত গম্ভীরবেদী রামমোহন কখনো কখনো প্রতিপক্ষের উদ্দেশে শ্লেষের বাণ বর্ষণ করেছেন। তার “এক খ্ৰীষ্টিয়ান পাদরী ও তাহার তিনজন চীনদেশস্থ শিষ্য, ইহাদের পরস্পর কথোপকথন” থেকে কিছু অংশ আমরা স্মরণ করতে পারি। পাদরি যথোচিত খ্ৰীষ্টধর্মের উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও তার তিনটি চৈনিক শিষ্য সমস্ত ব্যাপারটাই গুলিয়ে ফেলেছে। সব চাইতে মারাত্মক কথা বলেছে। তৃতীয় শিষ্য, সে জানিয়েছে ঈশ্বর নেই। “পাদরী ॥ ঈশ্বর নাই, যাহা উত্তর করিয়াছ, তাহাতে অত্যন্ত চমৎকৃত হইয়াছি ।
তৃতীয় শিষ্য ॥ এক বস্তুকে হস্তে লইয়া কহিলেন যে, দেখ, এই এক বস্তু বর্তমান আছে, ইহাকে স্থানান্তর করিলে, এ স্থানে এ বস্তুর অভাব হইবেক । পাদৱী । এ দৃষ্টান্ত কিরূপে এস্থলে সঙ্গত হইতে পারে। তৃতীয় শিষ্য। আপনারা পশ্চিম দেশীয় বুদ্ধিমান লোক, আমারদিগের ন্যায় নহে, আপনকারদিগের দুরূহ কথা আমারদিগের বোধগম্য হয় না। কারণ পুনঃপুনঃ আপনি কহিয়াছেন যে, এক ঈশ্বর ব্যতিরেকে অন্য ছিলেন না, এবং ঐ খ্ৰীষ্ট প্রকৃত ঈশ্বর ছিলেন। কিন্তু প্ৰায় ১৮০০ শত বৎসর হইল, আরবের সমুদ্রতীরস্থ ইহুদীরা তাহাকে এক বৃক্ষের উপর সংহার করিয়াছে। ইহাতে মহাশয়ই বিবেচনা করুন যে, ঈশ্বর নাই। ইহা ব্যতিরেকে অন্য কি উত্তর আমি করিতে পারি ?
পাদরী ৷ আমি অবশ্য ঈশ্বরের স্থানে তোমারদিগের অপরাধ মার্জনার জন্যে প্রার্থনা করিব । কারণ তোমরা সকলে প্ৰকৃত ধর্মকে স্বীকার করিলে না । অতএব তোমারদের জীবদ্দশায় এবং মরণান্তে চিরকাল যন্ত্রণায় থাকিবার সম্ভাবনা হইল ।
সকল শিষ্য। এ অতি আশ্চৰ্য, যাহা আমরা বুঝিতে পারি না এমত ধর্ম মহাশয় উপদেশ করেন, পরে কাহেন যে, তোমরা চিরকাল নরকে থাকিবে, যেহেতু বুঝিতে পারিলে না। ইতি।”
রামমোহনের এই কৌতুক তীক্ষ্ম এবং লক্ষ্যভেদী হলেও—এর রুচি মাৰ্জিত, এতে বিদগ্ধ রসিক মনের অভিব্যক্তি । কিন্তু এর পর থেকে বাংলা সাহিত্যে যেন পঙ্ক মন্থনের পালা এল। এবং তা শুরু হল প্ৰাচীন পন্থা আর নতুন চিন্তাধারার মধ্যে ।
রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তখন এনিমি নাম্বার ওয়ান। কুলীন ব্ৰাহ্মণের ছেলে কৃষ্ণমোহন কেবল ক্রীশ্চানই হয়েছেন তা-ই নয়, তার প্রভাবে দেশের ছেলেরা ধৰ্মকৰ্ম বিসর্জন দিচ্ছে, খাদ্যাখাদ্য মানছে না-বিলিতি আচারআচরণ গ্ৰহণ করছে এবং ক্রীশ্চন হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে তাঁর উপর আরম্ভ হল প্ৰচণ্ড আক্রমণ। “ব্যানরজি ভায়া” জাতীয় রচনায় হিন্দু সমাজের ক্ৰোধ ফেটে পড়ল।
কেবল “কেষ্ট ব্যাণ্ডো’ কেন ? স্বধর্মে বিধর্মী রামমোহন রয়েছেন , রয়েছেন ডিরোজিয়ো-‘সমাচার চন্দ্ৰিকা’সক্রোধে যাঁকে বলেছিল “দ্রুজো নামে অসুর”। আর এইসব প্ৰভাবের ফলে সৃষ্ট হচ্ছে নব্য সম্প্রদায়-যার নাম “ইয়ং বেঙ্গল”। অন্যদিকে কলকাতা তখন হঠাৎ জেগে উঠেছে, তৈরি হচ্ছে নব্য ধনিক সম্প্রদায় -বাঈজী-বুলবুলির লড়াই-খেউড় গানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে এক বেপরোয়া বাবুয়ানির স্রোত। এদের উপরেও আক্ৰমণ আসতে দেরি হল না। আক্রমণকারীদের পুরোভাগে এসে দাড়ালেন তৎকালীন ‘ধৰ্মসভার’ এবং ‘সমাচার চন্দ্ৰিকা’র খ্যাতনামা সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানীচরণের 'বাবু উপখ্যান', 'কলিকাতা কমলালয়', 'নব বাবু বিলাস' এই আক্রমণের কতগুলি রূপ। এতে যেমন ইয়ং বেঙ্গলদের কঠোর সমালোচনা-তেমনি নব্য ধনিকতন্ত্রের কুরুচি, সামাজিক বিকৃতি এবং অন্যান্য দোষক্ৰটির নির্মম নিন্দাবাদ । ভবানীচরণের সদিচ্ছা অবশ্যই ছিল, কিন্তু রুচি ছিল না। তাই বিকৃতির সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি নিজেই বিকৃত হয়ে উঠেছেন এবং “নব বিবি বিলাসের’ পাতা ওলটালেই বোঝা যাবে ক্রোধাপরবশ ভবানীচরণের কতখানি অধঃপতন ঘটেছিল, যে সুরুচির বিরুদ্ধে তার অভিযান --সেই কুরুচিই তাকে কতখানি পেয়ে বসেছিল।
কিন্তু ভবানীচরণের হাতে এই যুগে কৌতুক সাহিত্যের দ্বার মুক্ত হল। নতুনের আতিশয্য, ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে অনেক সময় মাত্ৰাহীনতার অভাব এবং নতুনকালের সন্ধিলগ্নে বিমূঢ়চিত্ততা থেকে যেমন প্রাচীনপন্থীরা কৌতুকের উপকরণ খুজে পেলেন, তেমনি নতুনরাও প্ৰত্যুত্তরের চেষ্টার ত্রুটি করলেন না। প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’নতুন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নীতিশিক্ষা প্রচারের সঙ্গে প্ৰাচীন পন্থার প্রতি সকৌতুক প্রতিবাদ রূপে উপস্থিত হল। ইংরেজি শিক্ষিত মধুসুদন খানিকটা অদলীয় নিরপেক্ষ জগতে বাস করেছিলেন। তিনি কোনো পক্ষকেই ক্ষমা করলেন না। তার দুখানি উৎকৃষ্ট প্রহসনে তিনি দুই দলেরই সমালোচনা করলেন। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য় যেমন তিনি মদ্যপান-বিলাসী নব্যবাবু সম্প্রদায়ের বিশ্লেষণ করলেন। —অন্যদিকে 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো'-তে প্ৰাচীন ভক্তপ্ৰসাদবাবুরাও বাদ পড়লেন না। আসলে তখন দু-দিক থেকেই আতিশয্যের রূপটা চক্ষুন্মানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ; মাইকেলের প্রহসনে আমরা সেই দৃষ্টিরই আলোকসম্পাত দেখতে পাই।
এর মধ্যে বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব ঘটেছে।
আপাতদৃষ্টিতে ঈশ্বর গুপ্ত রক্ষণশীল, “হুট করে বুট পায়ে যারা চুরুট ফুকে স্বর্গে” যেতে চায়, কিংবা টেবিলে গাদা ফুল সাজিয়ে যারা “ইয়ুভাবে খান খায়”,- অথবা যে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহের প্রবক্তা, এইসব প্ৰতিপক্ষের উপর তার ব্যঙ্গ প্রবলভাবে বর্ষিত হলেও—তিনিও মূলত যুক্তিবাদী এবং বাস্তব চেতনাসম্পন্ন মানুষ। প্ৰাচীন পন্থার প্রতি তাঁরও বিশেষ কোনো মোহ ছিল না। যা তার কাছে অসঙ্গত, অস্বাভাবিক এবং কৌতুককর মনে হয়েছে—তাকেই তিনি ব্যঙ্গের ও বিদ্রুপের আঘাত দিয়েছেন। যথোচিত শিক্ষা ঈশ্বর গুপ্তের ছিল না-কালের পাঠশালায় তিনি পাঠ নিয়েছিলেন। সেই সংক্ষুব্ধ সময়ের তরঙ্গে ঈশ্বর গুপ্তের মন যতটা ইতস্তত আন্দোলিত হয়েছে, সে-পরিমাণে কোনো নির্দিষ্ট স্রোত পায়নি। তাই ঈশ্বর গুপ্ত প্ৰগতিশীল না রক্ষণশীল এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শক্ত। তার সাহিত্যেয় নৌকো ঢেউয়ের মুখেই দোলা খেয়েছে-কোনো অনুকুল বায়ুতে পাল তুলে নির্দিষ্ট তটরেখার দিকে অগ্রসর হতে পারেনি।
তা ছাড়া ঈশ্বর গুপ্ত মূলত ছিলেন সাংবাদিক। জনরঞ্জনের দিকেই ছিল তার লক্ষ্য। সুতরাং তার পাঠকদের খুশি করার কাজেই নিজের শক্তিকে তিনি নিয়োগ করেছেন। বিদ্যাসাগর, চুনোগলির ফিরিঙ্গি, ভাটপাড়ার ভট্টাচাৰ্য কিংবা ঝাঁসীর রানী সকলেই তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। পাঠকদের করতালিতেই তিনি তৃপ্ত - জনপ্রিয় সাংবাদিকতার মধ্যে তার ব্যক্তিমতের সঠিক পরিচয় মেলে কিনা সন্দেহ।
কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের মধ্যে আরও একটি জিনিস বিকশিত হয়ে উঠেছিল-সে হল অস্ফুট স্বাদেশিকতার চেতনা। ইংরেজ সরকার এবং বিদেশী রাজতন্ত্রের প্রতি কিছু কিছু মৃদু-কঠোর ব্যঙ্গ তার কৌতুকে অন্যতর স্বাদ এনেছিল। “আমরা ভূষি পেলেই খুশি হব, ঘুষি খেলে বাঁচবো না। —” এর মধ্যে যে জালা ছিল— তা ভবিষ্যৎ ব্যঙ্গ সাহিত্যের আর একটি সম্ভাবনাকে সুচিত করে দিয়েছিল ।
ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্যরূপে দেখা দিলেন দীনবন্ধু ও বঙ্কিমচন্দ্ৰ। গুরুর ব্যঙ্গবিদ্রুপের সব ক-টি দিকই দীনবন্ধুর মধ্যে প্ৰতিফলিত হল। নব্য সম্প্রদায়ের মানস-বিকৃতির একটি রূপ এল “সধবার একাদশী’তে, আবার প্রাচীন কৌলীন্য প্রথার উপর প্রচণ্ড আক্রমণ পড়ল ‘জামাই বারিকে”। নাটুকে রামনারায়ণের ‘কুলীন কুলসর্বস্ব।” কৌলীন্যের উপর যে আঘাত হেনেছিল- দীনবন্ধু সেই আঘাতকে উচ্ছসিত কৌতুকে আরো মর্মঘাতী করে তুললেন। তার গম্ভীর নাটক “নীলদর্পণ”ও রঙ্গে-কৌতুকে উদ্ভাসিত—ঈশ্বর গুপ্তের স্বদেশিক চেতনা এবং বৈদেশিক শোষণের বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদের ধ্বনি এই নাটকে উচ্চারিত হল ।
আর অনন্য ব্যক্তিত্ব হলেন বঙ্কিমচন্দ্র । সার্থক কথাশিল্পীর হাতে রঙ্গ-ব্যঙ্গ-রসিকতা পরিপূর্ণ সিদ্ধিলাভ করল। বঙ্কিমের মানসলোক তখন নানা আলোড়ন-বিলোড়নে সমুত্তাল। অন্যতম প্ৰথম গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্ৰ যে অভিনব মন নিয়ে ‘কৃষ্ণচরিত্র’ এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ রচনা করেছিলেন, হিন্দুধর্মকে তিনি যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিভূমি দিতে চেয়েছিলেন, প্ৰাচীন হিন্দু সমাজের পক্ষে তা গ্ৰহণ করা সম্ভব ছিল না ; অপর দিকে তৎকালীন ব্ৰাহ্মসমাজ এবং ইওরোপের প্রতিপক্ষের সঙ্গেও তাকে মসীযুদ্ধ করতে হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্ৰ হিন্দুসমাজের সংস্কার চেয়েছিলেন, কিন্তু বিধবা বিবাহের সমর্থন করবার মতো মানসিক প্ৰবণতা তার ছিল না । বঙ্কিমের দেশপ্ৰেমে খাদ ছিল না-কিন্তু সরকারী চাকরি এবং ইংরেজের রক্তচক্ষু সেই দেশাত্মবোধের পরিপূর্ণ প্ৰকাশ ঘটতে দেয়নি। ইতিহাস পাঠে বঙ্কিম বাঙালীর এক মহিমোজ্জল অতীতের সন্ধান পেয়েছিলেন - কিন্তু তার সমকালে যে চাকুরিপ্ৰাণ ভীরু মধ্যবিত্তের দুর্বলতা প্ৰত্যক্ষ করেছিলেন।--তা তাঁকে বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল । বঙ্কিমের কৌতুক এই বিভিন্ন ঘাত-প্ৰতিঘাতেই উপজাত। কৌতুকের আড়ালে জ্বালা-হাসির আড়ালে চোখের জল। “লোক রহস্য’,‘মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ এবং সর্বোপরি ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বঙ্কিমের এই মনোযন্ত্রণার পরিচয় বয়ে এনেছে। বঙ্কিমের সাহিত্যিক প্ৰতিভার ছোয়ায় এই রচনাগুলি হীরের মতো জলজল করছে। আক্ৰমণ যতই তিক্ত হোক -শুচিতায় এবং মার্জিত বুদ্ধিতে এরা আশ্চর্য শিল্পসফল।
বঙ্কিমের কৌতুক-সৃষ্টি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সুপরিজ্ঞাত শ্রদ্ধাৰ্য্যটি আবার স্মরণ করছি:
‘বঙ্কিম সর্বপ্রথমে হাস্যরসকে সাহিত্যের উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত করেন। তিনিই প্ৰথমে দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে ; উজ্জল শুভ্ৰ হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্ৰথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে। যে বঙ্কিম বঙ্গ-সাহিত্যের গভীরতা হইতে অশ্রুর উৎস উন্মুক্ত করিয়াছেন সেই বঙ্কিম আনন্দের উদয়শিখর হইতে নবজাগ্ৰত বঙ্গ-সাহিত্যের উপর হাস্যের আলোক বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছেন।” রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনায় কৌতুক স্ৰষ্টা বঙ্কিমের বৈশিষ্ট্যটি সত্যরূপে প্ৰকটিত হয়েছে । উজ্জল-শুভ্ৰ হাসির আড়ালে কবি-দার্শনিক-দেশপ্রেমিকের যে গভীর সত্তাটি থেকে থেকে অশ্রুকরুণ হয়ে উঠেছে – সেইখানেই বঙ্কিমী-কৌতুকের ব্যাপ্তি ও ব্যঞ্জন।
“বিচারের বাজারে গেলাম— দেখলাম সেটা কসাইখানা। টুপি মাথায়, শামলা মাথায়-ছোটবড়ো কসাই সকল, ছুরি হাতে গোরু কাটিতেছে। মহিষাদি বড়ো বড়ো পশুসকল শৃঙ্গ নাড়িয়া চুটিয়া পলাইতেছে ; ছাগ মেষ এবং গোরু প্ৰকৃতি ক্ষুদ্র পশুসকল ধরা পড়িতেছে। আমাকে দেখিয়া গোরু বলিয়া একজন কসাই বলিল, “এও গোরু, কাটিতে হইবে।” আমি সেলাম করিয়া পলাইলাম।” এ যেমন কমলাকান্তের কথা, তেমনি লোক-রহস্যে “কোনো স্পেশিয়ালের পত্রে’ পরাধীনতা জর্জরিত ক্ষুব্ধ বঙ্কিমের আর একটি আত্মপ্ৰকাশ :
“দুঃখের বিষয় যে আমি কয়দিনে বাঙালিদিগের ভাষায় অধিক বুৎপত্তি লাভ করিতে পারি নাই ; তবে কিছু কিছু শিখিয়াছি। এবং গোলেস্তান এবং বোস্তান নামে যে দুইখানি বাঙ্গালা পুস্তক আছে, তাহার অনুবাদ পাঠ করিয়াছি। ঐ দুইখানি পুস্তকের স্থল মর্ম এই যে, যুধিষ্ঠির নামে রাজা, রাবণ নামে আর একজন রাজাকে বধ করিয়া তাহার মহিষী মন্দোদরীকে হরণ করিয়াছিল। মন্দোদরী কিছুকাল বৃন্দাবনে বাস করিয়া কৃষ্ণের সঙ্গে লীলাখেলা করিয়া পরিশেষে তাহার পিতা কৃষ্ণের নিমন্ত্রণ না করায় তিনি দক্ষযজ্ঞে প্ৰাণত্যাগ করেন ।”
এই আক্রমণ তখনকার ওরিয়েণ্টালিস্ট পণ্ডিতদের প্রতি। কিছুকাল মাত্র এদেশে বাস করে, ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যে নামমাত্র অধিকার নিয়ে যারা প্ৰাচ্য বিদ্যার গবেষণা করেন—তাদের উদ্দেশেই অপমানিত অভিমানী বঙ্কিম এ শ্লেষবজ্ৰ ক্ষেপণ করেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মসমালোচনা, দার্শনিক মনন এবং দেশপ্রেম তার কৌতুক সাহিত্যকেও একটা গভীর গুরুত্বে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে।
বঙ্কিমের চাইতে বয়সে নবীন হলেও কালীপ্রসন্ন সিংহ কৌতুকসৃষ্টিতে প্ৰবীণতর। তাঁর “হুতোম প্যাচার নকশা” ভবানীচরণ প্ৰভৃতির ঐতিহে রচিত হয়েও যুক্তিতে সুস্থ-বিচারে নিরপেক্ষ। নিৰ্ভীক কালীপ্রসন্নও তাঁর ছোট ছোট নকশাগুলির মধ্যে তৎকালীন প্ৰগতিশীল মনোভঙ্গিকেই রূপায়িত করেছেন। তীব্র আত্ম-সমালোচনা, সামাজিক ভণ্ডামির উন্মোচন এবং সেই সঙ্গে দেশাত্মবোধের দীপ্তি তাঁর রচনা থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে। রুচিতে কোথাও কোথাও কিছু গ্ৰাম্যতা আছে-কিন্তু অশালীনতা নেই। কালীপ্রসন্নের প্রভাবে যে ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের দল রুচিহীনতা এবং ইতর গালাগালির পসরা নিয়ে আসরে নেমেছিলেন, “বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে তাদের বক্তব্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য চোখে পড়তে কিছুমাত্র বিলম্ব হয় না। কলকাতার কথ্য ভাষার পরম দুঃসাহসী ব্যবহার কালীপ্রসন্নের কৌতুককে আরো প্ৰাণবন্ত এবং অন্তরঙ্গ করে তুলেছিল। কিন্তু হুতোম এবং বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাই পরবর্তী কৌতুকমূলক কথাসাহিত্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করল। হুতোমের প্রভাব একদল কুভাষাবিলাসী অনুকারকের উপর পড়ে পঙ্কের মধ্যে লুপ্ত হল, কিন্তু বঙ্কিমের রসিকতা থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত হলেন। রবীন্দ্রনাথের 'হাস্য-কৌতুক'-যার কিছু কিছু তাঁর প্রথম জীবনে ‘হেঁয়ালি নাট্য -( শ্যারাডের পদ্ধতিতে ) রূপে “বালক” পত্রিকায় প্ৰকাশিত হয়েছিল, তাদের উপর ‘লোক রহস্যের’ প্ৰভাব দুর্লক্ষ্য নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের হাস্যরস সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথ শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলেন, তা তাঁর নিজেরও প্ৰাপ্য । বঙ্কিম নিজে জাতীয়তাবাদী হিন্দু-ব্ৰাহ্ম-সমাজের প্রতি তাঁর যে বিশেষ পক্ষপাত ছিল, তা-ও নয়। বরং শেষের দিকে ব্ৰাহ্ম-সমাজের সঙ্গে তার কিঞ্চিৎ তিক্ত সম্পর্কেরই সৃষ্টি হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ পৰ্যন্ত সেই তিক্ততার মাত্ৰাধিক্য ঘটানোয় আনুকূল্য করেছিলেন। কিন্তু বঙ্কিমের হাসি ব্ৰাহ্ম-সমাজেরই নিকটনিহিত। সুরুচি, স্বচ্ছতা, বুদ্ধিগত প্ৰাখৰ্য এবং শিক্ষিত-পরিশীলিত মনন তাকে উদ্ভাসিত করে রেখেছে। তাই হাসির সৃষ্টিতে রবীন্দ্ৰনাথ বঙ্কিমেরই শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেছিলেন।
কিন্তু হিন্দু-রসিকতারও একটা নিজস্ব রূপ ছিল। সে রসিকতা ভবানীচরণ থেকে একটি অন্তঃশীল ধারায় বয়ে আসছিল-ত বঙ্কিমকেও ক্ষমা করেনি। বাংলাদেশে কেশবচন্দ্ৰ সেনের আবির্ভাবে তার একটি অভিনব বহিঃপ্রকাশ ঘটল । ব্ৰহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন একটি আশ্চর্য বিতর্কমূলক ব্যক্তিত্ব। অসামান্য পণ্ডিত-অদ্বিতীয় বক্তা। সমাজ-সংস্কারে এবং ধর্মপ্রচারে সমৰ্পিত প্ৰাণ, সমুচ্চ আদর্শবাদের উদঘোষক । কিন্তু ব্ৰাহ্ম হয়েও তিনি রামকৃষ্ণ ভক্ত, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েও নিজ কন্যার বাল্যবিবাহ দাতা, অপৌত্তলিক হয়েও হরগৌরীর সামনে তঁর নিজ কন্যা সম্প্রদান-যার জন্য শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো সংযতবাক মানুষেরও ধৈৰ্যচ্যুতি ঘটেছিল।
অথচ, বাঙালী তরুণদের উপর কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা ও ব্যক্তি মানুষের অদ্ভুত প্রভাব পডেছিল তখন। দলে দলে কলেজের ছাত্র কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা শোনবার জন্য ভিড় করত-অনেকেই ব্ৰাহ্মধর্মের দিকে পা-ও বাড়িয়েছিল। স্বভাবতই, হিন্দুসমাজের ক্ৰোধ এবং আক্রমণ ব্ৰাহ্ম-সমাজের দিকে পুর্ণোৎসাহে ধাবিত হল। কিছু কিছু ব্যঙ্গ ইতঃপূর্বে ছিলই, কেশবচন্দ্ৰকে কেন্দ্র করে তা একটা আন্দোলনে পরিণত হল।
কেশবচন্দ্ৰ প্ৰচারক পাঠিয়ে ব্ৰাহ্ম-ধৰ্ম বিস্তারের প্রয়াস করেছিলেন। এই প্রচারকেরা মেয়েদের মধ্যে গিয়ে কিভাবে তাদের ধর্মে আকৃষ্ট করেন-তাই নিয়ে অকথ্য কুৎসিত ব্যঙ্গ-রচনা প্ৰকাশিত হতে লাগল ; শিক্ষিতা ব্ৰাহ্মিকাদের সহজ মেলামেশাকে বিকৃত, বীভৎস করে দেখানো হতে লাগল ‘বিবির নাচ’জাতীয় রচনায়। এই দলেরই পরিমাজিত শক্তিমান সংস্করণ বঙ্গবাসীর যোগেন্দ্ৰচন্দ্ৰ বসু-যিনি “মডেল ভগিনী’ রচনা করেছিলেন । আর যোগেন্দ্ৰচন্দ্রের সঙ্গে বিকশিত হলেন আর একটি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব-তিনি হলেন ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । - “পঞ্চানন্দ’ ইন্দ্ৰনাথের রচনাবলী বর্তমানে প্ৰায় অপ্ৰাপ্যতার কোঠায় । কিন্তু “ভারত উদ্ধার কাব্যে’র অসামান্য রচয়িত, ‘পঞ্চানন্দের’ পরিবেশক একদা বাঙালীর চিত্ত জয় করে নিয়েছিলেন। ব্ৰাহ্ম-সমাজকে তিনি নির্মম ব্যঙ্গে বায় বার জর্জরিত করেছেন- কেশবচন্দ্ৰ তার প্রধান ‘টার্গেট’ ; কিন্তু ইন্দ্রনাথের পরিচয় ওখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর ছোটখাটো রঙ্গ-কৌতুকের উর্ধে যে ব্যঙ্গরসিক সত্তাটি বিরাজ করছে- সেটি দেশপ্রেমিকের-“পেট্রিয়ট স্যাটায়া রিস্টেটর’। যে আক্রমণ বঙ্কিম কিঞ্চিৎ কুণ্ঠার সঙ্গে করেছিলেন-ইন্দ্রনাথ সে আক্রমণে কোথাও ক্ষমা রাখেননি ; দুর্গাপুজা সম্পর্কে দারোগার গোপন রিপোটে, "কাবুলস্থ সংবাদদাতার রিপোর্ট সিরিজে’ 'কঙ্গরসের' অধিবেশনের ব্যাখ্যানে-দেশপ্রেমিকতার উজ্জল স্বাক্ষর রেখেছেন ইন্দ্ৰনাথ । নির্ভীকভাবে তিনি নতুনকালের দুর্গামূৰ্তির পরিকল্পনা জানিয়েছেন। এইভাবে ; দুর্গারানী ভিক্টোরিয়া, কাতিক-গণেশ স্ফীতোদর ইংরেজ বণিক, বলির পশু দেশের হিন্দু মুসলমান এবং খাড়া হাতে কামার-ইংরেজ রাজপুরুষ।
দু-একটি কাব্য ছাড়া ইন্দ্রনাথের অধিকাংশ রচনাই ব্যঙ্গাত্মক প্ৰবন্ধ-রিপোর্টাজের ভঙ্গিতে লেখা । এই লেখাগুলি সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের তির্ষক পরিচয় বহন করছে। স্থায়ী সাহিত্যের মর্যাদা হয়তো এদের অনেকেই দাবি করতে পারে না-কিন্তু খাটি দেশপ্রেমিকের দুঃসাহসী প্ৰয়াসরূপে এদের নিঃসংশয় ঐতিহাসিক গৌরব আছে।
ইন্দ্ৰনাথের কালেই আবির্ভূত হয়েছিলেন ত্ৰৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। এই লেখকটিও অসাধারণ। বাংলা দেশের পুরনো বৈঠকী গল্পের মধ্যে তিনি আনলেন সমাজ-সমালোচনা, উচ্ছসিত হাসির এবং উদ্ভট কল্পনাবিলাসের আড়ালে আনলেন সর্বসংস্কারমুক্ত পরিচ্ছন্ন বুদ্ধিবাদ। ত্ৰৈলোক্যনাথ কোনো দলের নন ; বাস্তব ব্যাপক অভিজ্ঞতায়, বহু দুঃখের মধ্য দিয়ে মানুষকে চিনেছিলেন তিনি, দেশকে ভালবেসেছিলেন। ত্ৰৈলোক্যনাথ পুরো হিউম্যানিস্ট । তাই তার কাছে ‘ব্যাঙসাহেব মিঃ গমিশ” আর ধর্মধবজী ‘ঢাক মহাশয়’, স্বদেশী কোম্পানির ডমরুধর আর ভণ্ড সন্ন্যাসী-সবাই সমান ধিক্কারের বস্তু। সর্বোপরি ভূত নিয়ে তার রসিকতা এক অপুর্ব কৌতুক স্রষ্টার প্রতিভাদীপ্ত চরিতার্থতা ।
ত্ৰৈলোক্যনাথের আরো কৃতিত্ব আছে। “লোক রহস্যের’ ‘সুবৰ্ণ গোলকে’ কিংবা ‘কমলাকান্তের” দু-একটি রচনায় ব্যঙ্গ গল্পের যে সুচনা ঘটেছিল, যার কিছু কিছু আভাস ছিল ‘হুতোম প্যাচার নকশায়'-ত্ৰৈলোক্যনাথের হাতে তা রূপ লাভ করল। ত্ৰৈলোক্যনাথ বাংলা সাহিত্যে নকশা আর রহস্যকে ছাড়িয়ে প্ৰথম খাটি হাসির গল্প লিখলেন । এ কাজ ইন্দ্ৰনাথও হয়তো করতে পারতেন খানিক পরিমাণে- কিন্তু রিপোর্টধর্মী রচনার মধ্যেই তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত হয়ে গিয়েছিল। তাই ত্ৰৈলোক্যনাথকেই এই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল । এবং, বলতে দ্বিধা নেই - যথাযোগ্য ভাবেই ত্ৰৈলোক্যনাথ এ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন ।
ত্ৰৈলোক্যনাথের কাছ থেকেই সম্ভবত পুর্ণাঙ্গ হাসির গল্পের প্রেরণা পেলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ত্ৰৈলোক্যনাথের উৎকল্পনা এবং রূপকের দিকে তিনি গেলেন না-পারিবারিক জীবনের, পারিপাশ্বিক সমাজের ছোটখাটো অসঙ্গতি, টুকরো টুকরো। হাসি এবং কৌতুককেই আশ্রয় করলেন তিনি। ত্ৰৈলোক্যনাথের গল্পের আঙ্গিক ছিল দুর্বল-প্ৰভাতকুমারের হাতে তা নিখুত আর নিপুণ হয়ে উঠল। বাংলা সাহিত্যে কৌতুক গল্পের কাহিনী এইভাবে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হয়ে উঠল। ইন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ব্যঙ্গ রচনায় প্রেরণা পেলেন প্রমথ চৌধুরী—এল “নীল লোহিত”, বৈঠকী গল্পের আসর বসালেন “ঘোষালের” গল্পমালায় । ত্ৰৈলোক্যনাথের মেজাজ নিয়ে, অথচ প্ৰভাতকুমারের পারিবারিকতা আশ্রয় করে গল্পের বৈঠক জমিয়ে তুললেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্যঙ্গ-কৌতুকের পসরা সাজিয়ে বসলেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ বসু। ত্ৰৈলোক্যনাথের কল্পনাবিলাস আরো সুমাজিত এবং নাগরিক হয়ে দেখা দিল পরশুরামের লেখায় ; এলেন রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, সজনীকান্ত দাস, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল। ত্ৰৈলোক্যনাথ- পরশুরামের পথে খানিকদূর এগিয়ে এলেন সম্বুদ্ধ। সুক্ষ্ম কৌতুকের বৈদগ্ধ্যে সংযত মৃদু হাসি বিকীর্ণ করলেন পরিমল গোস্বামী। “রাণুর’ ঘরোয়া গল্প নিয়ে আসরে এসে শিবপুরের গণশা অ্যাণ্ড কোংকে নিয়ে নির্মল হাসির ডালা সাজালেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। এক ঝলক আলোর মতো দেখা দিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, তাঁর রশ্মিতে দীপ্ত হলেন রূপদৰ্শী, নীলকণ্ঠ। কথার কারুশিল্পে আর রঙ্গসৃষ্টির বৈচিত্র্যে শিবরাম চক্রবর্তী একক মহিমায় বিরাজ করতে লাগলেন । বাংলা কৌতুক গল্পের ঐতিহাসিক পরিক্রম সংক্ষেপে মোটামুটি এই।- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
পাঠকরা এই ব্লগ হইতে 'সরস গল্প- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত' বইটি পিডিএফ সংগ্রহ করতে পারবেন। বইটিতে মোট ছত্রিশটি বিভিন্ন বিখ্যাত লেখকের লেখা সরস গল্প আছে।

সরস গল্প- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বাংলা ডিজিটাল বই 'সরস গল্প- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত' পিডিএফ সংগ্রহ করুন

No comments:

Post a Comment